উচ্চ মাধ্যমিকে নম্বর আশানুরূপ না-হলে বৃত্তিশিক্ষার পথে এগোনোর পরামর্শ দিয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি। তাঁর বক্তব্য, নম্বরের বিচারে যাঁরা মোটেই কৃতিত্বের পরিচয় দেননি, উচ্চশিক্ষার মূল স্রোতে ঠেলাঠেলি না-করেও তাঁরা এ ভাবে একই সঙ্গে কর্ম ও শিক্ষার পথ ধরতে পারেন।
এই পড়ুয়ারা কারা?
সংসদ-সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, যাঁরা ৩০ থেকে ৩৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন (সংসদের বিচারে ‘সি’ গ্রেড), এমনকী যাঁরা ৪০ থেকে ৪৯ পেয়েছেন (সি+) নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তাঁদের বৃত্তিশিক্ষার কথা বিবেচনা করা উচিত। কারণ, উচ্চশিক্ষার সাধারণ স্রোতে তাঁদের ভবিষ্যৎ মোটেই উজ্জ্বল নয়।
গত বছরের থেকে ১.৩৪ শতাংশ বেড়ে এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হার ৭৭.৮৮ শতাংশ। ছেলেদের পাশের হার ৭৯.২৫ শতাংশ, মেয়েদের ৭৬.৩৭ শতাংশ। বছর পাঁচেক বাদে এ বার মোট নম্বর ফিরেছে উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশিটে। তার ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে সার্বিক গ্রেড। তাতেই দেখা গিয়েছে, ‘সি’ (৩০%-৩৯%), ‘সি+’ (৪০%-৪৯%) পেয়েছেন দু’লক্ষ ৪৫ হাজার ৩১৬ জন। সফল পরীক্ষার্থীদের প্রায় ৫৩ শতাংশ।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও কর্মসংস্থানমুখী বৃত্তিশিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল, উচ্চ মাধ্যমিকের ‘অতিসাধারণ’ পড়ুয়াদের সকলেই কিংবা বেশির ভাগই যদি বৃত্তিশিক্ষায় যেতে চান, তা হলে এ রাজ্যে তাঁদের ঠাঁই নেই। উচ্চ মাধ্যমিকের পড়া শেষ করে বৃত্তিশিক্ষায় যেতে আগ্রহীদের জন্য আইটিআই, পলিটেকনিকের মতো কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ঢোকার সুযোগ আছে। এ ছাড়া কয়েকটি কলেজে বৃত্তিমূলক পাঠ্যক্রম পড়ানো হয়। যার মধ্যে ‘কমিউনিকেটিভ ইংলিশ’, ‘কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন’, ‘ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম’, ‘মাস কমিউনিকেশন’ ইত্যাদি আছে। কর্মশিক্ষার কিছু সংস্থান আছে ইন্দিরা গাঁধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়েও ৫০ হাজারের বেশি আসন নেই বৃত্তিশিক্ষায়।
রাজ্যে পালাবদলের পরে বর্তমান সরকারও বৃত্তিশিক্ষার উপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “দু’ধরনের শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের সরকারের নীতি। দুই শিক্ষার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। আমরা দু’ধরনের শিক্ষার প্রসারেই গুরুত্ব দেব।” শীঘ্রই বেশ কয়েকটি নতুন আইটিআই খোলা হবে বলে জানান কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু বৃত্তিশক্ষায় যদি ফি-বছর লক্ষাধিক ছেলেমেয়েকে আকর্ষণ করতে হয়, তা হলে আরও অনেক বেশি সুযোগ তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কর্তাদের অনেকেই। তাঁদের মতে, সুযোগ বাড়াতে না-পারলে ওই ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার মূল স্রোতেই ধাক্কা মারবেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন, উচ্চশিক্ষার সাধারণ স্রোতে সকলেই লাভবান হবেন না। তাঁর কথায়, “এমন অনেকে আছে, যারা পুঁথিগত বিদ্যায় তেমন পারঙ্গম নয়। কিন্তু তারা অন্য অনেক দিকে পারদর্শী। তাদের যদি ঠিক ঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, তা হলে তাদের নিজেদের তো বটেই, সমাজেরও অনেক উপকার হয়।” আশিসবাবুর মতে, দীর্ঘ কাল ধরেই বাঙালির মনোভাব সাধারণ শিক্ষা এবং ধরাবাঁধা চাকরির বৃত্তে
ঘুরছে। সমাজের প্রয়োজনেই সেখান থেকে বেরোনো দরকার।
অন্য অনেক ব্যাপারে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ফারাক থাকলেও রাজ্যের প্রাক্তন স্কুলশিক্ষা মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসও মনে করেন, বৃত্তিশিক্ষার প্রসঙ্গ তুলে মুক্তিনাথবাবু ঠিকই করেছেন। কান্তিবাবু বলেন, “সাধারণ ডিগ্রি-পাঠ্যক্রমের মধ্যে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বরং বৃত্তিমূলক শিক্ষার পরে
কাজের সুযোগ অনেক বেশি। স্বনির্ভরতারও সুযোগ বেশি। আমরা ক্ষমতায় এসে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার জন্য তো আলাদা
দফতরই করেছিলাম।”
কিন্তু সংসদ-সভাপতির কথায় যাঁদের ভবিষ্যৎ ‘উজ্জ্বল’ নয়, তাঁদের সংখ্যাটা এত বেশি কেন?
প্রশ্নটা তুলেছেন আইআইএম কলকাতার অধ্যাপক অনুপ সিংহ। নীতিগত ভাবে সংসদ-সভাপতির সঙ্গে একমত হয়েও তিনি বলেন, “মুড়ি-মুড়কি এক না-করে আলাদা বস্তায় রাখাই ভাল। কিন্তু এতগুলি ছেলেমেয়ে ‘মুড়কি’ না-হয়ে ‘মুড়ি’ হল কেন, তা দেখা জরুরি।”
মুক্তিনাথবাবুর মতে, প্রতি বিষয়ে কোনও রকমে ২৫ নম্বর পেয়ে যে-সব ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগের মান নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। মাধ্যমিকে পাশ করার ন্যূনতম নম্বর বাড়ানো যায় কি না, তা নিয়ে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে বলেও জানান তিনি। সংসদ-সভাপতি জানান, উচ্চ মাধ্যমিকের মান উন্নয়নের জন্য মূল্যায়ন পদ্ধতি, পঠনপাঠন এবং প্রশ্নের ধরন পাল্টানোর কথা ভাবা হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হবে। |