বাবা সেলাই করেন দর্জির দোকানে। ছেলে সেলাই করেছে ছেঁড়া স্বপ্ন। সেই ছোট্টবেলা থেকে।
বাঁকুড়ার খাতড়া হাইস্কুলের ছাত্র দীপাঞ্জন কুণ্ডু। অভাবের সংসার। তাই সামনে খোলা ছিল একটাই পথ। লেখাপড়া। দীপাঞ্জন জানে, লেখাপড়া ছাড়া গরিবের ছেলের আর কিছু করার নেই। বাবার আয় যৎসামান্য। পড়ার খরচ চালাতে তাই টিউশন করতে হয়েছে তাকে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কলা বিভাগে ৪৭১ নম্বর পেয়েছে সে। বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে লড়াই করে মেধা তালিকায় দীপাঞ্জন ষষ্ঠ স্থানে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্রোতে সে গা ভাসায়নি। তাই মাধ্যমিকে দুরন্ত ফল করেও ভর্তি হয়েছে কলা বিভাগে। দীপাঞ্জন চায়, শিক্ষক হতে। বাংলায় রচনা লেখার সময় ছাড়া ছাত্রদের এ-রকম ইচ্ছার কথা এখন প্রায় শোনাই যায় না। কিন্তু দীপাঞ্জন ব্যতিক্রম। খাতড়া শহরের রামকৃষ্ণ সরণিতে ওদের টালির ছাউনির ঘর। দীপাঞ্জন বলে, “ইংরেজি নিয়ে গবেষণা করতে চাই। শিক্ষক হব।” দীপাঞ্জনের স্কুলের শিক্ষকেরা যে ভাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা দেখেই ‘শিক্ষকতা’ পেশার প্রতি মেধাবী ছেলেটির অগাধ শ্রদ্ধা জন্মেছে।
ব্যতিক্রম শম্ভু মোদকও। জন্মের পর থেকেই ডান দিকের দৃষ্টিশক্তি খুব ক্ষীণ ছিল শম্ভুর। বাঁ চোখে একেবারেই দেখতে পায় না। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাই শুধু নয়, আর্থিক অনটনও প্রতি মুহূর্তে পড়াশোনায় বাধা তৈরি করেছিল বনগাঁর ধর্মপুকুরিয়ার শম্ভু মোদকের ক্ষেত্রে। বাবা বিজয়বাবু ভ্যান চালান। বনগাঁ হাইস্কুলের ছাত্র শম্ভু এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে পেয়েছে ৪০৬ নম্বর। |
|
|
|
|
|
|
শম্ভু মোদক |
শুভঙ্কর সিংহ |
পার্থ কপাট |
ফিরোজা ইয়াসমিন |
দীপাঞ্জন কুণ্ডু |
|
বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত জীবনেও শম্ভু স্বপ্ন দেখে, পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। শিক্ষকতা করবে। কিন্তু মোদক পরিবারের চিন্তা, ছেলেকে পড়ানোর টাকা আসবে কোথা থেকে। উচ্চ মাধ্যমিকে তাকে সাহায্য করেছেন দু’জন গৃহশিক্ষক। কেউই বেতন নেননি। চোখের চিকিৎসার জন্য শম্ভুকে নিয়মিত চেন্নাইয়ে যেতে হয়। তারও খরচ প্রচুর। ইতিমধ্যেই প্রচুর টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে বিজয়বাবুর। এত সবের মধ্যেও হাল ছাড়তে নারাজ শম্ভু। সে বলে, “আমি শিক্ষক হয়ে বিনা খরচে গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াতে চাই।”
বনগাঁ হাইস্কুলেরই আর এক ছাত্র শুভঙ্কর সিংহ। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে সে ৪৪৮ নম্বর পেয়েছে। এ বার এই স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর এটাই। তার বাবা স্মরজিৎবাবু স্কুলে বই ফেরি করেন। মা চায়নাদেবী বিড়ি শ্রমিক। দীনবন্ধু নগরের বাসিন্দা শুভঙ্করের এই হল পরিবারের আর্থিক চিত্র। বোন এ বারই মাধ্যমিক পাশ করেছে। দুই ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ চালাতে হিমসিম সিংহ দম্পতি। তবু লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে শুভঙ্কর। এই লড়াইয়ে তাকে স্কুলের শিক্ষকেরা তো বটেই, সাহায্য করেছেন আরও পাঁচ গৃহশিক্ষক। প্রত্যেকেই বিনা খরচে পড়িয়েছেন তাকে। অধ্যাপক হতে চায় শুভঙ্কর। সমস্যা একটাই। শুভঙ্করের প্রিয় বিষয় পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ার খরচ যে বিপুল!
শম্ভু-শুভঙ্করদের সহপাঠী পার্থ কপাট। পড়ে একই স্কুলে। পার্থর বাবা দীপঙ্করবাবু ট্রেনের হকার। মা প্রমিলাদেবী বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। পার্থ উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪২২ নম্বর পেয়েছে। ইংরেজি নিয়ে পড়ে অধ্যাপনা করতে চায় সে। কিন্তু সংসারে হাঁড়ির হাল। পার্থ বলে, “জানি না স্বপ্ন পূরণ হবে কি না। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কত দিন লড়াই চালাতে পারি দেখি!”
স্কুলের সেরা রেজাল্ট করে খুশি দুবরাজপুরের হেতমপুরের ফিরোজা ইয়াসমিন। কিন্তু পড়া চালাবে কী ভাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় হেতমপুর রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীটি। বিজ্ঞান বিভাগে মেয়েটি পেয়েছে ৪৪৬ নম্বর। পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়া চালাতে চায়। আর্থিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যুঝতে হয় মেয়েটিকে। বাবা ফৈরিদ মোল্লা সপ্তাহে দু’দিন হেতমপুর হাটে সব্জি বিক্রি করেন। সামান্য জমিতে ধান-সব্জি চাষ হয়। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাবার কথায়, “এত ভাল রেজাল্ট করল মেয়েটা। কিন্তু এখন আমাকে ভাবতে হচ্ছে ওর টিউশন, বইপত্রের খরচ নিয়ে।” ফিরোজা তিন বোন। বাকিরাও পড়াশোনা করে। সব মিলিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছে ফৈরিদের। |
তথ্য: দেবব্রত দাস, সীমান্ত মৈত্র, দয়াল সেনগুপ্ত। ছবি: উমাকান্ত ধর, পার্থসারথি নন্দী। |