অবশেষে ভারতীয় রেলের মানচিত্রে ঢুকে পড়ল আরামবাগ।
স্বাধীনতার পর থেকে রেল সংযোগের যে দাবি আরামবাগের মানুষ তুলছিলেন, এত দিনে তা পূরণ হল। সোমবার তারকেশ্বরের সঙ্গে রেলপথে সংযুক্ত হল আরামবাগ। অর্থাৎ, এখন হাওড়া-আরামবাগের মধ্যে ট্রেনে যাতায়াত করা যাবে। আরামবাগবাসী বলছেন, ‘এত দিনে আরাম এল আরামবাগে। কাছে এল কলকাতা।’’
বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরামবাগ থেকে ট্রেন চলাচলের সূচনা করেন। যে ট্রেনের ‘ভোঁ’ শোনার জন্য বছরে পর বছর অপেক্ষা করেছেন আরামবাগের মানুষ, সেই ট্রেন চলতেই করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে গোটা স্টেশন চত্বর। এই ‘ঐতিহাসিক’ মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে প্রবল গরমেও সকাল থেকে হাসিমুখে স্টেশন চত্বরে জড়ো হচ্ছিলেন মহকুমার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ। বেলা যত বেড়েছে, ভিড়ও তত বেড়েছে। বস্তুত, মেলার চেহারা নেয় গোটা স্টেশন চত্বর। চপ-মুড়ি, ঘুগনি-পাঁউরুটি, পাঁপড়ভাজা নিয়ে বসে পড়েন ব্যাপারীরা। আর বিক্রি হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি-সহ চাবির রিং, ব্যাজ, বাঁধানো ছবি।
আরামবাগে রেল সংযোগের জন্য সকলে ‘ধন্যবাদ’ জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। |
একটি ট্রেনকে ঘিরে এ দিন মানুষের আবেগ ছিল এতটাই! ছবি: মোহন দাস। |
স্বাধীনতার পর থেকে সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত হুগলির এই জনপদ যেন ‘বিচ্ছিন্ন’ই ছিল জেলার মূল অংশের সঙ্গে। কর্মস্থল আরামবাগ হলে সরকারি কর্মীরা তা ‘শাস্তি’ বলে মনে করতেন। সড়কপথে আরামবাগ যাওয়া ছিল সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টদায়ক। তারকেশ্বরের চাঁপাডাঙা থেকে আরামবাগের মায়াপুরের মধ্যে ১৮টি কাঠের সেতু ছিল। যা প্রতি বর্ষায় ভেঙে যেত। বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত মহকুমা। রেলপথে যেতে হলে কলকাতা থেকে সকলে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর যেতেন। তার পরে সেখান থেকে বাসে আরামবাগে আসতেন। সব মিলিয়ে প্রায় একটা গোটা দিন চলে যেত। আশির দশকে রাস্তার উন্নতি হয়। কলকাতা-আরামবাগ বাস চলাচলও বাড়ে। কিন্তু যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
এই পরিস্থিতিতে ট্রেনকে এক বিরাট প্রাপ্তি হিসেবেই দেখছেন আরামবাগের মানুষ।
সোমবার ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে আরামবাগ স্টেশনে চলে এসেছিলেন শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা পূর্ণিমা দে। বারবার রেললাইন ছুঁয়ে দেখছিলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা তাঁর কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হচ্ছিলেন। তাতে অবশ্য পূর্ণিমাদেবী থামেননি। তাঁর কথায়, “এ আমাদের গর্বের জিনিস। ৬টি জেলার সংযোগস্থল আরামবাগ। ভীষণ জরুরি ছিল এই রেলপথ। এত দিনের যাতায়াতের ঝক্কি থেকে এ বার রেহাই পাওয়া গেল।” ফাঁসিবাগান এলাকার বাসিন্দা সুকান্ত পাইন বেলা ১১টা থেকে বার তিনেক মোটরবাইকে ঘুরে গেলেন স্টেশন চত্বর। প্রতি বারই সঙ্গে দু’জন করে বন্ধু। কেন বারবার পাক খাচ্ছেন? সুকান্তের কথায়, “ব্যবসা করি। বড়বাজারে যেতে হয়। বাসে যাতায়াত দুঃস্বপ্ন ছিল। এ বার আর অসুবিধা হবে না।” এলাকার অর্থনীতি কী ভাবে বদলাবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল আরামবাগের পুরনো সব্জি-বাজারে। সব্জি-বিক্রেতা সুব্রত অধিকারীর মতে, “এ বার ফসল নিয়ে শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুর, হাওড়া বা কলকাতার যে কোনও বাজারে যাওয়া যাবে।” হাসি ফুটেছে রিকশা-চালকদের মুখেও। আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড থেকে স্টেশন তাঁরা ২৫ টাকা ভাড়া পাবেন বলে আশা করছেন।
আরামবাগে ট্রেন মানুষের এই আবেগ যে কতদূর গভীর, তা এ দিন টের পাওয়া যাচ্ছিল ডানকুনি পেরনোর কিছুটা পর থেকেই। আরামবাগ-তারকেশ্বর রোডের দীর্ঘ ৫০ কিলোমিটার জুড়ে এই রেলপথের কথা তোরণে, ফ্লেক্সে, হোর্ডিংয়ে জানানো হয়েছে। আর ধন্যবাদ জানানো হয়েছে রাজ্যের ‘নব রূপকার’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সিপিএম পরিচালিত আরামবাগ পুরসভার পক্ষ থেকেও রাস্তার দু’প্রান্ত জুড়ে তোরণ বানানো হয়। সেখানেও রেল যোগাযোগের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রেলমন্ত্রী মুকুল রায়কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। পুরপ্রধান গোপাল কচ বলেন, “সরকারি অনুষ্ঠান। তাই পুরসভার পক্ষ থেকে সরকারি ভাবেই অভ্যর্থনা জানানো হয়। এই প্রকল্প এবং অনুষ্ঠানের জন্য পুরসভার পক্ষ থেকে সব রকম সাহায্য করা হয়েছে। তা ছাড়া, সৌজন্যও দেখানো উচিত বলে আমরা মনে করি।”
এ দিন যাঁরা আট কামরার ট্রেনে আরামবাগ থেকে তারকেশ্বর গেলেন, তাঁদের অনেকেরই যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। আনন্দের আতিশয্যেই তাঁরা ট্রেনে চড়েন। কামরায় জায়গা না পেয়ে অনেকে ট্রেনের ছাদে উঠে পড়েন। তালপুরে বিদ্যুদয়নের কাজ হয়ে যাওয়ায় রেল পুলিশকে ট্রেন থামিয়ে ছাদ থেকে লোকজনকে নামাতে হয়। এত ভিড়ে ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। |