প্রবন্ধ ২...
জলা ভরাট হচ্ছে, আবার প্লাস্টিক দমনে সাফল্য এসেছে
রিবেশ এখনও এ দেশের ভোট পাওয়া বা না-পাওয়ার কারণ হয়ে ওঠেনি। ফলে পরিবেশ নিয়ে রাজনীতিকদের আগ্রহ কম। দূষণ নিয়ন্ত্রণে যেটুকু কাজ হয় তার সিংহভাগই কোনও না কোনও আদালতের নির্দেশে। গত এক বছরে রাজ্যের নতুন সরকার পরিবেশের প্রশ্নে কী করল, পরিবেশ দিবসে এক বার তা ফিরে দেখা ভাল।
কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশমন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজন সম্প্রতি লোকসভায় জানান, দূষণ ছড়ানোর নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ সবার উপরে! রাজ্যে শিল্প-দূষণের এই দশা এক বছরে হয়নি। পরিবেশ নিয়ে আগের সরকারের ৩৪ বছর ধরে ধারাবাহিক শিথিলতাই এর কারণ। কয়েক বছর আগেই দেশের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঠাঁই করে নেয় দুর্গাপুর, আসানসোল ও হাওড়া। পরিবেশ দূষণ বেড়ে যাওয়ায় গত চার বছর ধরে হলদিয়া, হাওড়া ও আসানসোলের শিল্পাঞ্চলে বড় মাপের শিল্প স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক।
গত দশ বছরে বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার মতো সুখা এলাকায় একটার পর একটা স্পঞ্জ আয়রন কারখানা তৈরি হওয়ার পর থেকেই শিল্প-দূষণে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্যকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় আইন ও বিধি-নিষেধ অগ্রাহ্য করে ওই কারখানাগুলো ক্রমাগত উৎপাদন বাড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় সরকারি রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে, জ্বালানি হিসেবে নিকৃষ্ট মানের কাঁচা কয়লা ব্যবহার করায় স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় দূষণ বেশি হয়। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে স্পঞ্জ আয়রন কারখানা গ্যাস-নির্ভর। কেবল বায়ু দূষণ নয়, কারখানাগুলো মাটির নীচ থেকে বিপুল পরিমাণ জল তুলে নেওয়ায় ওই সব গ্রামে চাষের জমির আর্দ্রতা কমে গিয়েছে, জলস্তর নেমে যাওয়ায় শ্যালো টিউবওয়েলে সেচের জল উঠছে না। এ ছাড়া কালো ধুলোর আস্তরণে ঢেকে যাওয়া ঘাস এবং বিচালি খেয়ে মারা যাচ্ছে গবাদি পশু। কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। গ্রামের মানুষের শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ এবং শিশুদের শ্লেষ্মাজনিত অসুস্থতা বেড়েছে।
এখনও চলছে। সেই টু স্ট্রোক অটোরিকশা।
গত এক বছরে এ দৃশ্য বদলায়নি। ওই এলাকার মানুষের এতটুকু স্বস্তিও মেলেনি। গত বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিষ্কৃতি দেবেন। তাঁর দলীয় ইস্তাহারেও সে প্রতিশ্রুতি ছিল। অথচ গত এক বছরে নতুন সরকার অনেক রকম কাজে উদ্যোগী হলেও স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণ রোধে প্রায় কোনও ব্যবস্থাই করেনি। তবে মন্ত্রী নিজে দু’বার ওই এলাকায় গিয়ে কারখানাগুলোর দূষণের হাল সরেজমিনে দেখে এসেছেন। শিল্প-দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এক বছর নিশ্চয়ই অত্যন্ত কম সময়। কিন্তু শিল্প-দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও এখনও পর্যন্ত পরিবেশ দফতর বা পর্ষদের নেই। তবে আশার ক্ষীণ আলো একটা আছে। সম্প্রতি হলদিয়ায় দূষণের মাত্রা কমায় সেখানে শিল্প স্থাপনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার জন্য নটরাজনের কাছে দাবি জানান স্থানীয় সাংসদ। গত মাসে পরিবেশ মন্ত্রকের এক দল প্রতিনিধি হলদিয়া ও সংলগ্ন এলাকায় ঘুরে যে-রিপোর্ট দিয়েছেন, তা যথেষ্ট ইতিবাচক।
বায়ু দূষণ সংক্রান্ত সমস্যা এক সময় ছিল শহরের একচেটিয়া। এখন তা গ্রামগুলোকেও গিলে খাচ্ছে। তা বলে শহরের নিষ্কৃতি নেই। শহর থেকে অতি-দূষণকারী শ্রেণিভুক্ত কারখানাগুলো সরিয়ে দেওয়ার পরে শহরের বাতাসে দূষণ ছড়াচ্ছে যানবাহন। কলকাতা এবং শহরতলির ভয়ানক বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কলকাতা হাইকোর্ট ১৫ বছরের পুরনো বাস ট্যাক্সি লরি বাতিল করার যে নির্দেশ দিয়েছিল তা আগের সরকার এক বছর কার্যকর করেই বন্ধ করে দেয়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গত এক বছরে হাইকোর্ট তার নির্দেশের কথা একাধিক বার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরেও রাজ্য সরকার পুরনো যান বাতিল করার ব্যাপারে কিছুই করেনি। হাইকোর্টেরই নির্দেশে কলকাতা থেকে টু স্ট্রোক অটো রিকশা বাতিল হয়েছে, তার জায়গায় ফোর স্ট্রোক এলপিজি অটো রিকশা রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু কলকাতার বাইরে কাটা তেলের অটোই চলছে। একই অবস্থা শব্দদূষণের ক্ষেত্রে। যথেচ্ছ হর্ন বাজানোয় যেমন লাগাম দেওয়া যায়নি, তেমনই যানবাহনের এয়ার হর্ন বন্ধ করার ব্যাপারেও গত এক বছরে সরকার যা করেছে তাতে অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি।
তবে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে গত এক বছরে সামান্য হলেও সাফল্যের মুখ দেখা গিয়েছে। তার কতটা পরিবেশ দফতরের লাগাতার প্রচারে, আর কতটা পুরসভাগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে, সেই মূল্যায়ন পরে হবে নিশ্চয়ই। তবে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে গত এক বছর ধরে পরিবেশ দফতর কেবল প্রচারের ওপরেই ভরসা রেখেছে। জরিমানা আদায় না করলে যে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না তাও এত দিনে প্রমাণ হয়েছে। আর, রোজকার হাজারো পণ্য আমাদের ঘরে ঢোকে প্লাস্টিকের মোড়কে। সেই প্লাস্টিক সংগ্রহ করে তা রিসাইক্ল করার ব্যবস্থা না করলে কোনও দিনই প্লাস্টিক বন্ধ করার পূর্ণ সুফল মিলবে না। গত এক বছরে পরিবেশ দফতর এ ক্ষেত্রে কিছু করে উঠতে পারেনি।
অবশ্য জলাভূমি ও জল সংরক্ষণের ব্যাপারে বড় রকমের কাজে হাত দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমত্রীর ‘জল ধরো, জল ভরো’ স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার জন্য রাজ্যের বড় বড় ঝিল, দিঘি এবং পুকুর সংস্কার করে জলাশয় সংস্কারের পরিকল্পনা করেছে পরিবেশ দফতর। প্রথম পর্যায়ে কলকাতা ও শহরতলির দশটি জলাশয়কে চিহ্নিত করে সেগুলি সংস্কার এবং তার চারপাশের পরিবেশ পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হবে। এহেন ‘মহৎ’ কাজ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশকর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, জলাশয় পুনরুদ্ধার পরিবেশ দফতর বা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পষর্দের কাজ নয়। এই কাজ সেচ দফতর বা মৎস্য দফতরের। পরিবেশ দফতর এবং পর্ষদের কাজ নজরদারি এবং দূষণকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে তার সুপারিশ করা। তাই যদি হয় পরিবেশ দফতর আর পর্ষদের কাজ, তা হলে চার পাশে যখন রোজ চোখের সামনে জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, সে দিকে চোখ যায় না কেন?
বিশেষত উত্তর শহরতলিতে পুকুর ভরাটের এমনই রমরমা এবং তার পিছনে অর্থ ও পেশি শক্তির এমনই দাপট যে স্থানীয় মানুষ টুঁ শব্দ করতে পারছে না। বিরাটিতে এমনই এক অসহায় অবস্থায় পড়ে, প্রতিবাদের সাহস করতে না পেরে সেখানকার একটি ছোট্ট পরিবেশ সংগঠন ‘মৃত জলাশয় আর বৃক্ষের জন্য শোক পালন’ করেছে সম্প্রতি। পুকুরগুলো রাতারাতি ভরাট হয়ে গেলেও প্রায় সব ক’টি ক্ষেত্রেই পর্ষদকে জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। কোনও ব্যবস্থা হয়নি।
অথচ এক বছরে জলাশয় ভরাট বন্ধ করে তা মৎস্যজীবীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার অনন্য এক নজির এই সরকারই সৃষ্টি করেছে। পূর্ব কলকাতা জলাভূমির একটি ভেড়ি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে তার জল পাম্প করে তুলে ভরাট করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়ে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও কলকাতা পুরসভাকে সঙ্গে নিয়ে এক দিনের মধ্যে সেই পাঁচিল ভেঙে জলাশয়টি ফের মৎস্যজীবীদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। এ রাজ্যে জলাশয় ভরাট বন্ধে এমন উদ্যোগ নজিরহীন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.