নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর নিবন্ধের (নীচ থেকে উঠে আসা গণতন্ত্র, ২৪-০৫) পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। লেখাটির বিশ্লেষণধর্মিতার একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। কিন্তু যে বিষয়গুলি প্রায় অনুচ্চারিত, তা কিছুটা উল্লেখ করা দরকার।
সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্টের ক্ষমতা অর্জনের পশ্চাতে মতাদর্শগত শক্তির প্রাবল্য যতটা না ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল তৎকালীন সমসাময়িক অস্থির আর্থসামাজিক পরিস্থিতি। দেশভাগজনিত কারণে উদ্বাস্তু-স্রোতকে তৎকালীন সরকার-বিরোধিতায় পর্যবসিত করা এবং উদ্বাস্তু কলোনিগুলি থেকে রাজনৈতিক কর্মী নিযুক্তির আতুরঘর নির্মাণ ছিল সেই সময়কার বাম নেতাদের অবশ্যই কৃতিত্বের কাজ। এ নিয়ে পার্টির মধ্যে সন্দেহ ও মতবিরোধ ছিল। কারণ বঙ্গীয় উদ্বাস্তু সমাজকে ‘শ্রেণি’ দৃষ্টি থেকে দেখা যায় না। তাই ক্ষমতায় আসার পর এই বিরাট উদ্বাস্তু সমাজ থেকেই জন্ম নিল নতুন এক ধরনের শিক্ষিত সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ। |
বাম আন্দোলনের ক্ষেত্রে নকশাল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাঙালি সমাজের এক মেধাবী প্রজন্ম হারিয়ে গেল বা বাংলার বাইরে প্রবাসী হয়ে গেল। মধ্যমেধার মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের হাতেই চলে গেল বাম নেতৃত্বের ছড়ি। তাই দেখা যায়, সিপিএমের ৮৫-৯০ জনের রাজ্য কমিটি গঠন কিংবা সম্পাদকমণ্ডলী গঠনে যে সদস্যদের প্রাবল্য থাকে তাঁরা হলেন শহুরে পাতি বুর্জোয়া সমাজের এসএফআই, ডিওয়াইএফআই থেকে উঠে আসা নেতা।
একই সঙ্গে গ্রামবাংলার ক্ষেত্রেও প্রাথমিক শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধানের রসায়ন সৃষ্টি করল নতুন ধরনের গ্রামীণ ক্ষমতাকেন্দ্রিক এলিট। এই ভাবে শহর ও গ্রামের মধ্যে একটা ‘পলিটিকাল চ্যানেল’ তৈরি হল ভোট ব্যাঙ্ককে সুনিশ্চিত করতে এবং গণতন্ত্রের ‘শোকেস’ নির্মাণে। এরই অন্তরালে গুদামঘরে তৈরি করা এক ভিন্ন ধরনের আতঙ্ক ও ত্রাসের মেকানিজম, যা ব্যবহার হয় পশ্চিমবঙ্গের বিগত কয়েক দশক ধরে চলে আসা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি থেকে বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে পরিদৃশ্যমান গণতন্ত্রের ভোটাভুটির দিন ‘টি-২০’ ম্যাচে জেতার জন্য।
প্রশ্ন হল, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি কি এই বিষয়গুলি জানত না, বুঝত না, তবে কেন এত দেরিতে প্রতিবাদী হল? আসলে এখানে মিশে আছে বাঙালির চরিত্রগত দ্বিচারিতা এবং এর সঙ্গে সংযোজন ঘটেছে পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তু বাঙালি সমাজের অন্তঃস্থলে আইনি-সাংবিধানিক প্রশাসনিকতার বদলে সমান্তরাল ‘জবরদখল সংস্কৃতি’র অঙ্গস্বরূপ অবৈধতাকে বৈধ বলে মেনে নেওয়ার অভ্যাস। হালতুর মতো জবরদখল উদ্বাস্তু কলোনি অঞ্চলে জন্ম ও বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেখেছি, কী ভাবে একটা গোটা উদ্বাস্তু সমাজের সিপিএম-করন করা হয়েছিল মহিলা সমিতি, নাগরিক কমিটি, প্রগতিশীল বিজ্ঞানচেতনা প্রসার মঞ্চ, ঢাকুরিয়া ক্লাব সমন্বয় সমিতি, হালতু ক্রীড়া-সংস্কৃতি চক্র, এমনকী অঞ্চলের হরিসভাগুলিতেও এলসিএম (আঞ্চলিক সিপিএম সদস্য)-দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে।
এই যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী পশ্চিমবাংলার সমাজ-রাজনীতি একাকার হয়ে এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সাবালকত্ব লাভ করেছেতার পরিবর্তন কি এত দ্রুত সম্ভব? আজকের উদীয়মান তৃণমূলের যুব নেতারা সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রজন্মগত সন্তান। একই সঙ্গে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী মহাশয় ‘আয়রন ল অব ওলিগারকি’র কথা বলেছেন। নতুন সরকারের গুণী-মানব বন্দনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নতুন ‘আয়রন ল অব ওলিগারকি’ নির্মাণের পর্ব কি শুরু হয়ে যায়নি?
আসলে আমার কাছে যে প্রসঙ্গটা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়, তা হল পশ্চিমবাংলায় তথ্য-প্রযুক্তির হাত ধরে ‘মিডিয়া গভর্নান্স’-এর যুগের সূচনা হয়েছে। এটা ভাল কিংবা মন্দ সেটা এই আলোচনায় আসার সময় হয়নি।
আর একটি দিকেরও সূচনা হয়েছে, তা হল জনসংস্কৃতি থেকে উৎপন্ন গণ-রাজনীতির সদস্যদের সরকারি নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্রমশ চাপ সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এই গণ রাজনীতির ‘গণ’রা হলেন শহুরে অটোচালক ভাইয়েরা, ফুটপাথে বসা হকার, খালপাড়ে বসবাসকারী মানুষজন, আয়লার মতো দুর্যোগের কবলে পড়ে কিংবা মালদার নদী-ভাঙনের কবলে পড়ে সামাজিক ও আর্থিক ভাবে সর্বহারা মানুষজন। নাগরিক হিসেবে আমরা যখন চিন্তিত হই বা চিৎকার করি নাগরিক অধিকার হারালে বা হারানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেতখন এই জনসমষ্টি দাবি করে, ‘দাবি আদায়ের অধিকারের’। এই ‘দাবি আদায়ের অধিকার’ অধিকারেরই প্রাক্ শর্ত। রাজনৈতিক দলগুলি এই অধিকার দেওয়ার বদলে এক ধরনের বোঝাপড়ার রাজনীতির বশীকরণ-মন্ত্র দিয়ে বশে আনার চেষ্টা করে। এর ফলে রাজনৈতিক সামাজিক অস্থিরতার ক্ষতগুলি আরও প্রসারিত হয়। নাগরিক সমাজের লোকেদের কাছেও তাই এই জনসমষ্টির সমান্তরাল অবস্থান লোভনীয়, কারণ এদের হাতিয়ার করে নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির অঙ্গনে নেতা হওয়ার সুযোগ মেলে।
সৌমেন চক্রবর্তী। হালতু, কলকাতা-৭৮
|
গণতন্ত্রে তো দলতন্ত্রের ছায়া |
অম্বিকেশ মহাপাত্রের ঘটনায় কোনও ‘ট্রেনিং’ ছিল না, মাননীয় নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী এ কথা জানলেন কেমন করে? হ্যাঁ, লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে হয়তো তিন জন হাসিমুখে বলেনি‘ঘটনাটা ঠিক হয়নি স্যর’। কিন্তু শাসক দলের সর্বময় নেত্রী সর্বত্র বলেছেন, একাধিক বার বলেছেন, ভ্যানিশ কথার অর্থ খুন। এটা কি বিরোধী মতকে চোখ রাঙানো নয়? আপনি যার স্তুতি করলেন, তিনি তো আদ্যোপান্ত খামখেয়ালি করে আসছেন। তিনিই বলেছিলেন মাওবাদী এ রাজ্যে নেই, এখন তিনিই বলছেন ওই লোকটা মাওবাদী। টিভি চ্যানেলে পড়ুয়ারা প্রশ্ন করলে তিনি তাদের ‘মাওবাদী’ বলেন এবং পুলিশি তদন্তের ভয় দেখান। এটাই কি আপনার ‘নীচ থেকে উঠে আসা গণতন্ত্র’! সংবাদপত্রে বিরূপ সমালোচনা হলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সংবাদপত্রের নাম নিয়ে, ‘ওগুলো পড়া হবে না’। প্রশাসনিক তদন্তের আগেই উনি বলে দিচ্ছেন ‘সাজানো ঘটনা’। সর্বত্র দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাকুলতা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি, অথচ আপনি আমাদের দেখতে বলছেন ‘গণতন্ত্র’!
কৌশিকরঞ্জন খা।ঁ বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর
|
গৌতম চক্রবর্তী তাঁর প্রতিবেদনে (১৪-৪) গৌতম ভদ্রের উক্তি উল্লেখ করে বলেছেন, জরুরি অবস্থার প্রথম বলি শঙ্কর’স উইকলি। গৌতম ভদ্রের কথাটি ঠিক নয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন মধ্যরাতে আচমকা জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার আগেই শঙ্কর তাঁর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শঙ্করের জীবনীকার অলকা শঙ্কর বলেছেন হি ওয়াজ নিয়ারিং সেভেনটি-ফাইভ, অ্যান্ড হ্যাড টু টেক এ ডিসিশন সুন। ‘শু্যড আই কনটিনিউ উইথ দ্য উইকলি, অর ক্লোজ ইট ডাউন টু ডিভোট মোর টাইম টু দ্য চিলড্রেনস বুক ট্রাস্ট অ্যান্ড ইট’স অ্যাক্টিভিটিজ?’ হি আস্কড হিমসেল্ফ ওভার অ্যান্ড ওভার এগেন। অ্যান্ড, ওয়ান ডে, ইন মে ১৯৭৫, হি অ্যানাউন্সড দ্যাট হি ওয়াজ পুটিং ডাউন হিজ পেন অ্যান্ড ব্রাশ ওয়ানস ফর অল। ‘নো মোর কার্টুনিং ফর মি।’ হি ডিক্লেয়ারড উইদাউট এনি সেকেন্ড থটস (শঙ্কর, পৃ: ৮৬-৮৭)।
বিমলেন্দু ঘোষ। কলকাতা-৬০ |