আমাদের সহপাঠী এক ছাত্রনেতা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোনও দায়িত্বের কাজ করতে হলে বা ঝামেলায় ফাঁসলে সে বলত, ‘বলি শোন, আলোচনায় বসি’। যেমন, কমন-রুমে আলোর ব্যবস্থা করতে হবে বা বাথরুমে পর্যাপ্ত জল এমনতর কথা উঠলেই তার বাঁধা গত, ‘বলি শোন, আলোচনায় বসি’। এক বার দৈবাৎ দুই যুযুধান ছাত্রের মাঝে পড়ে গিয়ে কী এক কারণে দু’জনেরই মার খেতে খেতে সে ক্রমাগত বলে চলেছিল ‘বলি শোন, আলোচনায় বসি’! ঠিক উল্টো ছিল আর এক সহপাঠী, তারক। কোনও কাজেই তর সয় না, এখুনি প্রতিকার চাই। সেই সঙ্গে ছিল ‘অন্যের উপকার’ করার অদম্য বাসনা। এক বার হাওড়া স্টেশনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, নবদ্বীপগামী এক বৃদ্ধের কাছে কেবল নবদ্বীপের ‘ন’-টুকু শুনে, দীর্ঘ লাইন দিয়ে তার জন্য নলহাটির টিকিট কেটেছিল! |
দুঃখ ও কৌতুকের কথা এই যে, শৈশব থেকেই বাঙালিরা মোটামুটি ওপরের দু’টি টাইপে বিভক্ত হয়ে যায়। হয় তারা সারা জীবন ঘুম থেকে উঠেও ঝিমিয়ে থাকে এবং আশপাশের সবাইকে ঝিমিয়ে রাখে, নতুবা, ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়’ হওয়ার আপ্তবাক্য প্রাণিত হয়ে অঞ্চল কাঁপিয়ে বেড়ায় ‘কথা’ ও ‘কাজ’কে মেলাতে পারে না। জন-নেতৃত্বেও এরই প্রতিফলন: হয় তারা ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ একটা বাঁশের খুঁটি পুঁততে লোকাল থেকে গ্লোবাল, নানা কমিটির বিপুল সম্মেলন করেও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না; নয় ‘হাসছি মোরা আহ্লাদী’ টাইপ ভোরে উঠেই ‘চল কোদাল চালাই’-এর সুর ভাঁজতে ভাঁজতে কোনও-না-কোনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।
এই পোড়া রাজ্যে অবশ্য বলিয়ে-কইয়ে টিভিশোভন নেতা-নেত্রীকুলে প্রথম টাইপটিই সংখ্যাগুরু, যারা সারা দিন ধরে দ্বিতীয় টাইপের ‘ভুলচুক’-এর খতিয়ান নিয়ে সন্ধেয় সমস্বরে ‘তাসের দেশ’-এর বাসিন্দাদের মতোই বলে ওঠে ‘ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা!...’ সম্প্রতি আই পি এল-জয়ী কলকাতা নাইট রাইডার্স টিম ও তার অন্যতম মালিক, বলিউডের হার্টথ্রব-তারকা তথা রাজ্যের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ শাহরুখ খানকে ঘিরে কলকাতা/রাজ্যবাসীর যে বিপুল উন্মাদনা এবং সেই স্বতঃস্ফূর্ততাকে সামান্য সংগঠিত করে রাজ্য সরকার ও তার অধিনায়িকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতার রাজপথ থেকে ইডেনের মাঠে যে সংবর্ধনা দেওয়া হল, তাতে নানা বাংলা ব্র্যান্ডের গানের সঙ্গে শাহরুখ-জুহি চাওলার নাচের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্যপাল যে অদৃষ্টপূর্বভাবে করতালি দিলেন, গ্যালারিতে লক্ষাধিক মানুষ যে ভাবে উত্তাল হল, মুখ্যমন্ত্রীর মাথায় স্নেহচুম্বন দিয়ে যে ভাবে শাহরুখ তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং তা নিয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যম থেকে রাজনীতির গলি ও রাজপথে বড়-মেজ-খুচরো বিরোধী নেতারা যে ভাবে ‘গেল গেল’ রব তুললেন, দেখেশুনে মনে হল, পশ্চিমবঙ্গ আছে পশ্চিমবঙ্গেই ‘ইন্দ্রের বিদ্যুৎ পর্যন্ত একে নাড়া দিতে পারে না, অন্যে পরে কা কথা’!
ঠিক, আই পি এল হল চটজলদি ক্রিকেট + কুড়মুড়ে বিনোদনের ককটেলে মহাবাণিজ্যের সুবর্ণ সমাহার, যেখানে কেকেআর-এর শাহরুখ থেকে মুম্বই ইন্ডিয়ানের নীতা অম্বানিরা ছুটে আসেন শেষমেশ বাণিজ্যিক মুনাফার জন্যই। তাই, স্থানীয় ভাবাবেগ কব্জা করতে, সংগঠনে স্থানীয় মানুষের যোগদান ছাড়াই ক্লাবের সঙ্গে বিশেষ স্থানের নাম জুড়ে দেওয়া হয়। ক্লাবগুলি চলে মালিকের মর্জিতে। ওই মালিকেরা বিশেষ স্থানটির বাসিন্দা হতেও পারেন (যেমন, মুম্বইয়ের নীতা অম্বানী বা চেন্নাইয়ের শ্রীনিবাসন) অথবা না-ও হতে পারেন, যেমন, কলকাতায় শাহরুখ বা পুণেতে সুব্রত রায়। যদিও স্থানীয় ক্রিকেটের উন্নতিকল্পে কিছু করার দায় এঁদের নেই। ফলে, এঁদের সাফল্যে মাতামাতি বা ব্যর্থতায় ভেঙে পড়া, সবটাই অর্থহীন। এই সব কথার পিঠে অবশ্য গণ-উন্মাদনায় গা-ভাসানো জনতাকুল পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারে প্রাদেশিক, আঞ্চলিক বা জাতীয় টিম গড়ার সময়েই বা কখন সাধারণ মানুষদের যুক্ত করা হয়? যুক্তিসঙ্গত হলেও, তাদের অ-পছন্দের তোয়াক্কা কি করেন ক্রিকেট-কর্তারা? তবু তো তারা কেবল নামের মোহেই এই সব দলকে গলা ফাটিয়ে সমর্থন করে। আসলে নিষ্ক্রিয় যোগদান ও সক্রিয় সমর্থন এটাই তো পুঁজি নিয়ন্ত্রিত আধুনিক গণ বা জনপ্রিয় সংস্কৃতির মূল কথা। বিনোদন, খেলাধুলো, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ফ্যাশান, খাদ্যাভ্যাস বা আর্চি-র কার্ড কোনটাই-বা জনগণের ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভরশীল? তাই কূটকচালি তুলে জনতার ষোল আনা অধিকার উদ্দাম আনন্দপ্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে কেন, বিশেষত এই কীর্তি (অ্যাচিভমেন্ট)-বুভুক্ষু রাজ্যে!
এ হেন জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে আবেগ টিকে থাকে ক্ষণিকতায় বা তাৎক্ষণিকতায় এই নয়নের মণি তো এই চোখের বালি। এবং রাজনীতির মানুষদের মধ্যে অনেকেই যুগে যুগে চেয়েছেন জনপ্রিয় আবেগের বাতাস নিজের রাজনীতির পালে লাগাতে। যদিও এ কাজে সিদ্ধিলাভ করেন মুষ্টিমেয় ব্যক্তি। যেমন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ও তুরস্কের খালিফার অপসারণ-জনিত ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে গাঁধীজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলন সফল করায় প্রয়াসী হয়েছিলেন। আসলে, জনপ্রিয় রাজনীতির নায়ক তিনিই হতে পারেন, যিনি ঠিক সময়ে গণ-আবেগ, তার স্পন্দন বুঝতে পারেন। বামপন্থীদের মধ্যে সাম্প্রতিক অতীতে এটা যিনি সবচেয়ে সফল ভাবে করতে পেরেছেন, তিনি হলেন প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী। নিজেই বলতেন, মরা মানুষ বাঁচানো ছাড়া তিনি আর সব কিছু কয়েক ঘণ্টায় করে দেখাতে পারেন। দলের এলিট ভ্রুকুটিকে পাত্তা না দিয়ে বিভিন্ন গণরঞ্জনী অনুষ্ঠান আয়োজনে (যেমন, হোপ ’৮৬) তাঁর জুড়ি ছিল না। বেঁচে থাকলে এবং দল ক্ষমতায় থাকলে যে চক্রবর্তীমশাই এ বার এমনই পেল্লায় সংবর্ধনায় ব্রতী হতেন, এ ব্যাপারে বাজি ধরা যায়। বামপক্ষে আর এক জন ছিলেন, প্রয়াত যতীন চক্রবর্তী, যিনি চটপট মানুষের মুড বুঝতে পারতেন। ইন্দিরা গাঁধী নিহত হলে তাঁর চিতাভস্মপূর্ণ একটি কলস সব রাজ্যে ঘোরানো হয়েছিল। ভারতে তখন চলছে গণশোকপর্ব। হঠাৎ টিভিতে দেখি, কলকাতার ভিক্টোরিয়ার লোকারণ্য প্রাঙ্গণে গাড়ি থেকে কলস নামানো হলে তা নিজে থেকেই চলতে শুরু করেছে! ক্যামেরা জুম করলে বোঝা গেল, আসলে ছোটখাটো চেহারার যতীনবাবু ওই কলস মাথায় নিয়ে চলেছেন চারি দিকের ভিড়ে তাঁর শরীরটি দৃশ্যমান না হওয়াতেই এই দৃষ্টিবিভ্রম!
তবে নিয়ন্ত্রণহীন জনপ্রিয় রাজনীতির ঢেউয়ে চড়া মানে কিন্তু বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া। এটা গাঁধীজি হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলেন বিহারের চৌরিচৌরার পুলিশ চৌকিটি (উপস্থিত সব সিপাই-সহ) গণরোষে ধ্বংস হলে। তাই, আজ যারা মুম্বইয়ের মহানায়কের ছবিতে ফুলের মালা পরাচ্ছে, কাল ব্যর্থ হলে সে ছবি ছিঁড়তেও তাদের বাধবে না সেই আঁচ লাগতে পারে জনপ্রিয় রাজনীতিকের গায়েও। নইলে গতকালও চোখের মণি সৌরভ আউট হতেই ইডেনের একটা বড় অংশ এমন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে কী করে? জনতার মুড বা আবেগকে গুরুত্ব দিয়েও যিনি প্রয়োজনে তার রাশও টানতে পারেন, তিনিই রাজনীতির জাদুকর বিরল ক্যারিশমা বা জনমোহিনী শক্তির অধিকারী। এই যোগ্যতার অভাব-জনিত কারণেই কি ভাবুক-সেজে-থাকা এলিট নেতাদের জনপ্রিয় রাজনীতির চর্চায় এত অ্যালার্জি? না কি চেনা-ভদ্রজনের বৃত্তের বাইরে বলেই এত আপত্তি পরিচিত/অজানা/অজ্ঞাতকে নিয়ে মানসিক অস্বস্তি এবং তা চাপা দিতেই নিয়ম/প্রথা/প্রোটোকলের বাণীর উদ্গিরণ? আমজনতা যদি ‘আনন্দের দিনে’ এই সব নিয়ম/প্রথার অর্থ খুঁজে না পায়, তবে এই মহাশয়রা ‘তাসের দেশ’-এর ছক্কার মতোই তর্জনী তুলে বলতে পারেন ‘অর্থ? অর্থের কী দরকার। চাই নিয়ম।...’
কী আর করা যাবে, সুকুমার রায় লিখিত (চিরকালীন) ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’র বাড়ির ঠিকানা তো এই ‘বাংলা’তেই!
|
শ্রীচৈতন্য কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |