বাকিংহাম প্রাসাদ নামে এক বিপুল রাজভবন ছিল। সেখানে রাজা ও রানি সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করিতেন। মহারানির রাজত্বকালের ছয় দশক পূর্তি হইল। সেই উপলক্ষে দেশবাসী উৎসবে মত্ত। আলোয় সাজিল প্রাসাদ। সুদৃশ্য জলযান নদীতে বিহার করিল। এই পর্যন্ত কোনও রূপকথা হইতে পারিত। কিন্তু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ-এর রাজত্বের ছয় দশক পূর্তি উপলক্ষে বিলাতের সাম্প্রতিক উৎসব রীতিমত একুশ শতকী বাস্তব। সেই বাস্তবতা, সমস্ত আলোকমালার ভিতরেও, একটি নাছোড় প্রশ্ন তুলিবে। এই উদ্যাপন কেন? একটি উত্তর সুবিদিত। মহারানির গরিমা যে ভাবে নিজস্ব বৃত্তের ভিতরে থাকিয়া জনতার রাজ-গর্বকে লালন করিয়াছে, তাহারই উদযাপন চলিতেছে। অথচ, সোনার ঘড়ি যে ক্রমাগত বলিল, সময় চলিয়া যায়, তাহার খোঁজ কে রাখিবে? কে-ই বা সাহস করিয়া বলিবে, মহারানি আসলে প্রত্নসামগ্রীর ন্যায়, বর্তমান-এ তাঁহার কোনও সার্থকতা নাই।
এমন নহে যে সেই অতীত-এর কোনও সার্থকতা ছিল না। সভ্যতার ক্রমবিকাশের একটি পর্বে রাজতন্ত্র সমাজ সংগঠনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল। বিলাতেও ছিল। অতঃপর, টেমস নদীতে বিস্তর জল বহিয়া গিয়াছে। রাজতন্ত্র ক্রমে মুখ ঢাকিয়াছে রূপকথায়। সেই রূপকথা যে ঘটমান বর্তমানের অংশ নহে, তাহা স্বীকার করা দরকার। করিবে কে? বিলাতভূমি তাহা ভুলিয়া আছে দিব্য। জনতার সিংহভাগ রাজগৌরবে দিশাহারা। ফলে, যে প্রশ্নটি উঠিতে পারিত, কিন্তু উঠিল না, তাহা ইহাই যে, এই উৎসব কেন? যদি রানির জন্য হয়, তাহা হইলে প্রশ্নটি আরও সূচিমুখ। রানি-র এই সাড়ম্বর অবস্থানই বা কেন? নিছক অতীত-বিলাস দিয়া ইহার সার্থকতা প্রমাণ করা চলিবে না।
যাহা অতীতে ছিল, তেমন অনেক কিছুই এখন নাই। রাজতন্ত্র নাই। সেই ক্ষেত্রে, রানির এই ব্যয়বহুল উত্তরাধিকারই বা থাকিবে কেন? কিছু জিনিসের অস্বীকরণেই পরবর্তী প্রজন্মের মুক্তি। সময়ের ধারা সেই রূপেই অগ্রসর হয়। রানির স্বীকৃতিই বা কোন যুক্তিতে বহাল থাকে? উত্তর আসিবে, প্রথা। কিন্তু একবিংশ শতক কি প্রথার অন্ধ অনুবর্তনেই সীমাবদ্ধ থাকিবে? বাকিংহামের ছায়া কি গ্রাস করিয়া দিবে প্রখর বাস্তবকে? যুক্তিটিকে ঈষৎ পূর্বাস্য করিলে ভারতের কথাও আসিয়া পড়ে। নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের ধারা এই দেশেও মহাসমারোহে হাজির। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল হইতে শুরু করিয়া সমগ্র দেশের রাষ্ট্রপতি, দুইটি গোত্রের ব্যক্তিগণই প্রকৃতপক্ষে সম্মানে সমুচ্চ, কিন্তু প্রশাসনিক অর্থে কার্যত ক্ষমতাহীন। সেই অর্থে, তাঁহারাও কি সত্যই অপরিহার্য? কেন রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির ন্যায় পদ এখনও বিদ্যমান থাকিবে, সেই প্রশ্নটি এড়ানো চলিবে না। রাজ-কাহিনির ধারা সময়ের সহিত ফিকা হইয়াছে। বাস্তব তাহাকে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া তুলিয়াছে। অথচ, করদাতাগণ সেই অপ্রাসঙ্গিকতাকে, সেই মহাস্থবিরতাকে কেন শিরোধার্য করিয়া বহন করিবেন, সেই উত্তর স্পষ্ট নহে। অথচ, উত্তরের সন্ধান জরুরি। ইংল্যান্ডে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ-এর রাজত্বের ষাট বৎসর পূর্তি উৎসব এই প্রশ্নগুলি তুলিয়া দিল। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। উৎসবের ঘোর তাহাকে আচ্ছন্ন না-করিলেই মঙ্গল। |