নবম শ্রেণিতে পাশ করতে পারেনি বাগদার চাতরাবাগি গ্রামের পঙ্কজ বিশ্বাস। বাবা হরিপদবাবু খেতমজুর। চরম অনটনের সংসারে ছেলের পড়ার খরচ চালানো তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাই গত বছর যখন ছেলে ফেল করল, তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, আর লেখাপড়া নয়। এ বার কাজ।
ছেলেকে পুণেতে পাঠিয়ে দেন ঠিকাদার শ্রমিকের কাজ করতে। পঙ্কজের অবশ্য সায় ছিল না। নতুন ক্লাস শুরুর পরে পঙ্কজ স্কুলে আসছে না দেখে স্কুল-কর্তৃপক্ষ খোঁজখবর নিতে পঙ্কজের বাড়ি যান। তার বাবার অসহায়তার কথা শুনে তাঁদের বোঝান। পঙ্কজ ফের স্কুলে ফিরে এসেছে। পঙ্কজের মা শেফালিদেবীর কথায়, “স্বামীর সামান্য আয়ে কোনওরকমে সংসার চলে। ছেলের পড়ার খরচ চালানো সম্ভব নয়। তাই ওকে কাজে পাঠাই। কিন্তু যখন মাস্টারমশাইয়েরা বাড়িতে এসে আমাদের বোঝালেন, মাধ্যমিক পাশ করলে অনেক সুযোগ আসতে পারে, তখন ছেলেকে ফিরিয়ে আনি।”
শুধু পঙ্কজ নয়, উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার গোয়ালবাগি খগেন্দ্রনাথ বিদ্যানিকেতন কর্তৃপক্ষ ফি-বছরই প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করে স্কুলছুটদের স্কুলমুখী করছেন। স্কুলের ৯০ শতাংশেরও বেশি ছেলেমেয়ে অতি দরিদ্র পরিবারের। |
কারও বাবা ভ্যানচালক, কেউ খেতমজুর, দিনমজুরি করেন। সংসারের হাল ফেরাতে পড়ুয়াদেরও বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করতে হয়।
স্কুল-কর্তৃপক্ষ জানান, বছর দশেক আগে স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা আরও বেশি ছিল। সেই সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিসকুমার বিশ্বাসের উদ্যোগে শুরু হয় স্কুলছুটদের ফিরিয়ে আনার কাজ। ২০০৬ সালে স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন হীরেন্দ্রনাথ সমাদ্দার।
সহ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী এবং পরিচালন সমিতির সদস্যদের নিয়ে তিনি ওই প্রক্রিয়া আরও জোরদার করেছেন। প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর স্কুল-কর্তৃপক্ষ অনুত্তীর্ণদের তালিকা তৈরি করেন। যারা স্কুলে আসে না, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী এবং পরিচালন সমিতির সদস্যেরা সরাসরি তাদের বাড়িতে হাজির হন। অভিভাবকদের বোঝান।
এর সুফলও পেয়েছেন স্কুল-কর্তৃপক্ষ। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর ৬০ জন পড়ুয়া ফেল করে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার মধ্যে ৩৬ জনকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে। হীরেন্দ্রনাথবাবু বলেন, “বর্তমানে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ স্কুলছুট পড়ুয়াকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। সব চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মেয়েদের ক্ষেত্রে। নবম শ্রেণিতে ফেল করলে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।” গোয়ালবাগি গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র বিকাশ বিশ্বাস, চাতরাবাগি গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্র তন্ময় হালদার, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সদানন্দ পালরা ফেল করে স্কুল ছেড়ে দিয়ে ফের স্কুলে ফিরে এসেছে শিক্ষকদের উদ্যোগেই। ফেল করা ছাত্রদের স্কুলে ফেরানোই নয়, তাদের পড়াশোনার প্রতিও বিশেষ নজরদারিও থাকে স্কুলের। হীরেন্দ্রনাথবাবু বলেন, “ওই ছাত্রদের পড়াশোনার দিকে মাস্টারমশায়রা বিশেষ ভাবে নজর দেন। তাদের সব রকম সাহায্য করা হয়।”
স্কুলছুটদের ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি প্রধান শিক্ষকের উদ্যোগে পড়ুয়াদের ছবি আঁকা এবং নাচ শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার প্রধান উদ্যোক্তা হীরেন্দ্রনাথবাবু। প্রতি শনিবার স্কুল ছুটির পরে বাইরে থেকে শিক্ষকেরা এসে পড়ুয়াদের নাচ, আঁকা শেখান। এ বাবদ খরচের পুরোটাই বহন করেন প্রধান শিক্ষক। আচমাতারা মণ্ডল, সাগরিকা মণ্ডল, সঙ্গীতা বিশ্বাসরা বলে, “কখনও নাচ শিখতে পারব ভাবিনি। স্কুল আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে।” |