দিল্লির যন্তর-মন্তরে অণ্ণা হজারের সভায় তেমন লোক জুটছিল না তখন। ‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে’ এর পর থেকেই তাঁর সফর বাতিল করতে শুরু করেছিলেন অণ্ণা। এমনকী, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অণ্ণা-শিবির যে চাঁদা তুলেছিল, তার অপব্যবহার নিয়েও নিজেদের মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল চাপানউতোর। সামগ্রিক ভাবে ‘টিম-অণ্ণা’ যখন ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ও ‘ছত্রভঙ্গ’ হচ্ছিল, তখন তাদের আনা অভিযোগের ‘অকারণ’ জবাব দিতে শুরু করে মনমোহনই ‘টিম-অণ্ণা’কে ফের প্রাসঙ্গিক করে দিচ্ছেন বলে মনে করছেন কংগ্রেসের একটা বড় অংশ। কংগ্রেস সূত্রে খবর, দলের উদ্বেগ নিয়ে গত কাল কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
মাসখানেক চুপচাপ থাকার পর গত শনিবার এক সাংবাদিক বৈঠকে ‘টিম-অণ্ণা’ প্রধানমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ১৫ জন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ ছিল কয়লা খনি বণ্টনের প্রসঙ্গে। কংগ্রেস নেতৃত্ব সে দিন কৌশলগত ভাবেই অণ্ণা-শিবিরের সেই অভিযোগকে কোনও গুরুত্ব দিতে চাননি। কারণ দলীয় হাইকম্যান্ডের এই অবস্থানই ছিল যে, অণ্ণাদের ওই অভিযোগে আমল দেওয়া মানে তাঁদের অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া। তাই কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি সে দিন বলেছিলেন, “চাঁদার টাকার অপব্যবহার নিয়ে অণ্ণা শিবিরের মধ্যেই ঝগড়া চলছে শুনেছি। ওঁরা সম্ভবত সে দিক থেকে মুখ ঘোরাতে চাইছেন।”
অণ্ণা শিবির যখন ওই অভিযোগ তোলে, তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিদেশ সফরে। দেশে ফেরার পথে বিমানে এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে মনমোহন বলেন, “এই ধরনের অভিযোগ দুর্ভাগ্যজনক। অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রধানমন্ত্রিত্ব কেন, রাজনীতিই ছেড়ে দেব।”
মনমোহনের এই মন্তব্যের পর ফের ‘টিম-অণ্ণা’ সাংবাদিক বৈঠক করেন। ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা কয়লা মন্ত্রকের কাজকর্ম নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন ও সে ব্যাপারে তদন্ত দাবি করেন। তাঁদের সাংবাদিক বৈঠক শেষ হতেই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে ফের একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। তাতে ব্যাখ্যা করা হয় যে, কয়লা খনি বণ্টনে কোনও দুর্নীতি হয়নি। এ ব্যাপারে কয়লা মন্ত্রকের একটি বিবৃতিও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল বলেন, “এর পর কয়লা খনি বণ্টন নিয়ে তদন্তের আর কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না।” কিন্তু অণ্ণারা তা শুনবেন কেন? বরং তদন্তের দাবি নিয়ে তাঁরা আরও সুর চড়াতে শুরু করেন। গত কাল কয়লা খনি বণ্টন নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। কাল থেকে প্রাথমিক তদন্তের কাজ শুরু করে দেয় সিবিআই। সিবিআই সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহেই তারা কয়লা মন্ত্রকে গিয়ে কয়লা খনির বরাত পাওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলি কী ভাবে তা ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে নথি সংগ্রহ করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে কয়লা মন্ত্রকের ব্যাখ্যা চাওয়া হতে পারে।
মজার বিষয় হল, এতেও খুশি নয় অণ্ণা-শিবির। তারা নতুন করে রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে বলেই মনে করছে কংগ্রেসের একটা অংশ। বিশেষ করে অণ্ণা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে ভাবে কামান দেগেছেন, তাতেও তাঁদের মনোভাব স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে অণ্ণা বলেন, “উনি হলেন এক ‘রিমোট কন্ট্রোলড’ ব্যক্তি। আর সে জন্যই যত মুশকিল। আমি মনে করি না যে, প্রধানমন্ত্রী নিজে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু তিনি হয়তো এটা অন্য কারও জন্য করেছেন।” এই স্বঘোষিত গাঁধীবাদী নেতার কথায়, “যদি প্রধানমন্ত্রীর সমস্যাই না থাকে, তা হলে কয়লা খনি বণ্টন নিয়ে দুর্নীতির তদন্তের দায়িত্ব কেন সিবিআই-কে দিচ্ছেন? কেন নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না।” অণ্ণার দাবি, “অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে কমিটি গঠন করে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হোক।” অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বক্তব্য, “নিরপেক্ষ তদন্তের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী ভয়ে পালাচ্ছেন কেন?”
তাৎপর্যপূর্ণ হল, কয়লা খনি বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিজেপি বেশি সরব ছিল না। কেন না তারাও মনে করছিল, কয়লা খনি নিলাম করে বণ্টন করা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাতে বিদ্যুৎ মাশুল বাড়বে। সেই বিজেপি-ই এখন পরিস্থিতি দেখে অণ্ণাদের অভিযোগে হাওয়া দিতে শুরু করেছে। এমনকী এ নিয়ে তদন্তের দাবিতে নেমে পড়েছেন বামেরাও।
প্রধানমন্ত্রীর কারণেই বিষয়টি ‘তিল থেকে তাল’-এ পরিণত হল বলে মনে করছেন কংগ্রেসের একটা বড় অংশ। ঘরোয়া আলোচনায় দিগ্বিজয় সিংহ, অম্বিকা সোনি, প্রণব মুখোপাধ্যায়, চিদম্বরমরা বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন। কংগ্রেসের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “অণ্ণা-শিবির এতটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল যে, তাদের কটাক্ষ করে বলিউডে ছবিও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ওদের অভিযোগের জবাব দেওয়ায় ওরা ফের গুরুত্ব পেল!”
দলের আর এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “টিম-অণ্ণা প্রধানমন্ত্রী-সহ ১৫ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজেকে বাঁচাতে মুখ খুললেও সতীর্থদের বাঁচাতে মন্তব্য করেননি।” সর্বভারতীয় কংগ্রেসের এক সাধারণ সম্পাদকের কথায়, “ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিবিআই তদন্তের নির্দেশও দিয়ে দিয়েছেন। ফলে সরকারের তরফে অণ্ণাদের জবাব দিতে আর কিছু করার নেই। বরং রাজনৈতিক ভাবেই কংগ্রেসকে অণ্ণাদের মোকাবিলার কৌশল খুঁজতে হবে।” |