তিন ঘণ্টার সফরে কলকাতা যাওয়া প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছে আজ দুপুরেই পেট্রোলের বর্ধিত মূল্য পুরোপুরি প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার কয়েক ঘণ্টা পরেই তেল বিপণন সংস্থাগুলি পেট্রোলের দাম কমালো বটে, কিন্তু লিটার-পিছু মাত্র ১ টাকা ৬৮ পয়সা। এর সঙ্গে ভ্যাট যোগ করলে লিটারে সাকুল্যে ২ টাকার মতো দাম কমবে পেট্রোলের।
এটুকু মূল্য হ্রাসে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি নন মমতা। অখুশি সরকারের আর এক শরিক দল ডিএমকে-ও। মন ওঠেনি বিরোধী বাম-বিজেপি-র। গত ২৩ মে পেট্রোলের দাম এক ধাক্কায় লিটার-পিছু প্রায় সাড়ে সাত টাকা বাড়ার পর প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন মমতা। জানিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষের উপর এ ভাবে বোঝা চাপানোয় তাঁর আপত্তি রয়েছে। তিনি চান, বর্ধিত মূল্য পুরোপুরি প্রত্যাহার হোক। দিন দুয়েক আগে যখন পেট্রোলের দাম ১ টাকা ৬০ পয়সা কমার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয় তখনও তিনি বলেছিলেন, এটুকু দাম
কমানো অর্থহীন। আর আজ সেই জল্পনা সত্যি হওয়ার পরে মমতার প্রতিক্রিয়া, “যতটা দাম কমানো হয়েছে, তাতে আমি মোটেই খুশি নই। যা বাড়ানো হয়েছে, তার পুরোটাই কমানো উচিত ছিল।”
শনিবারের এই মূল্যহ্রাসকে অবশ্য বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার (রোল ব্যাক) আখ্যা দিতে রাজি নন তেল প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ। তিনি বলেন, “তেল বিপণন সংস্থাগুলি বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করেনি। মে মাসের দ্বিতীয় অর্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম কিছুটা কমেছে। তার ভিত্তিতেই আজ কিছুটা দাম কমানো হয়েছে।”
তেল সংস্থাগুলির বক্তব্য, মে মাসের প্রথম অর্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি গড়ে ১২৪.৩৭ ডলার। সেই সঙ্গে ডলারের নিরিখে টাকার দাম কমে হয়েছিল ৫৩.১৭ টাকা। তার পর টাকার দাম আরও কমেছে ঠিকই, কিন্তু মে মাসের দ্বিতীয় অর্ধে অশোধিত তেলের দাম কমে ব্যারেল প্রতি গড়ে ১১৫.৭৭ ডলার হয়েছে। সেই কারণে পেট্রোলের দাম কমানো হল। |
কলকাতায় দাম |
• কী ছিল: ৭৭.৮৮ টাকা
• কী হল: ৭৫.৮১ টাকা
• কত কমলো: ২.০৭ টাকা |
|
পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম আরও কমছে। আজ তা ব্যারেল প্রতি একশো ডলারের নীচে নেমে গিয়েছে। ২০১১ সালের অক্টোবরের পর এই প্রথম। অশোধিত তেলের দামের এই অধোগতি অব্যাহত থাকলে ১৫ দিন পর ফের পর্যালোচনা করে দাম আরও কমতে পারে।
আজ মমতা যখন তেলের দাম কমানোর জন্য সওয়াল করেন, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেন, তেল সংস্থাগুলি লোকসানে চলছে। তাই এই মূল্যবৃদ্ধি। মমতা নিজেই এ কথা জানিয়ে বলেন, “আমি বলেছি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও এখানে বাড়ানো হল কেন? দাম বাড়ানো একেবারেই উচিত হয়নি।”
এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, অর্থনীতির হিসেবনিকেশ রাজনীতি অনেক সময়েই শুনতে চায় না। তাই বিরোধী দলগুলি এবং সরকারের শরিক-সমর্থকেরা তো বটেই, কংগ্রেসের একাধিক শীর্ষ নেতাও তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরব হয়েছেন। এবং দলের কাছে সেটা প্রত্যাশিতই ছিল।
গত বুধবার পেট্রোলের দাম বাড়ানো নিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি বলেছিলেন, ‘এই পদক্ষেপ সঠিক নয়’। আজ অনাবাসী ভারতীয় মন্ত্রী ভায়লার রবি পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী জয়পাল রেড্ডিকে চিঠি লিখে বলেছেন, ভবিষ্যতে তেলের দাম বাড়ানোর আগে সব দিক ভাল করে খতিয়ে দেখা উচিত। তেল
সংস্থাগুলির লোকসান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, আপাত ভাবে এই দাবি ঠিক নয় বলেই মনে হয়।
কংগ্রেসের ওই নেতা বলেন, দাম বাড়ার দায় যে কেউ নিতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক। তবে মুখে বিরোধিতা করলেও সরকার কোন পরিস্থিতিতে দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল, তা শরিকরা জানেন। আর তাই ক্ষোভ দেখালেও তৃণমূল বা ডিএমকে কেউই সমর্থন প্রত্যাহারের কথা বলছে না। কংগ্রেসের কাছে সেটাই স্বস্তিজনক।
তবে পেট্রোলের দাম বাড়ালেও সরকার ডিজেলে কেন ক্রমাগত ভর্তুকি দিয়ে চলেছে, সেই প্রশ্ন তুলেছে বণিকসভা ও শিল্প মহল। তাদের বক্তব্য, ডিজেলের দাম না-বাড়ানোয় সদ্য সমাপ্ত আর্থিক বছরে তেল সংস্থাগুলির ৮১,১৯২ কোটি টাকা কম আদায় (আন্ডার রিকভারি) হয়েছে। এ ভাবে ভর্তুকি দিলে ঘাটতি আরও বাড়বে। বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে তা একেবারই উচিত নয়। বস্তুত এই কথাটাই গত ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নোট পাঠিয়ে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সি রঙ্গরাজন। তিনি বলেছেন, “পেট্রোপণ্যের ভর্তুকি বাবদ বাজেটে ৪৩,৫৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ এর বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার তেল সংস্থাগুলিকেও আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ রাখা জরুরি। তাই পেট্রোল ও ডিজেলের দাম লিটার প্রতি চার টাকা করে বাড়াতে হবে।”
এর পরেও সরকার ডিজেলের দাম বাড়াচ্ছে না কেন? কংগ্রেসের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, অর্থনীতির উপরে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অনেক গভীর। ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহণ খরচ বাড়বে। ফলে বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। মূল্যবৃদ্ধির হার এমনিতেই এখন যথেষ্ট বেশি।
সরকারের অন্য অংশের আবার মত, মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলেও ডিজেলের দাম বাড়ানো উচিত। কেননা, দাম না-বাড়ানোর ফলে ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে। তবে ডিজেলের দাম বাড়ালে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও অনেক বেশি হবে। সেটা কতটা, সেই জল মাপার কাজটাই এখন করছে কংগ্রেস ও সরকার। |