সিনেমা সমালোচনা ১...
ভূতং স্মরণম
টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে যখন ভূতের গল্প নতুন করে ফিরে আসছে, ঠিক তখনই মুক্তি পেল জয়দীপ ঘোষ পরিচালিত ছবি ‘মায়াবাজার’।
২০০৯ সালে এনএফডিসি প্রযোজিত এই ছবি প্রায় তিন বছর পরে এমন একটা ভৌতিক জনপ্রিয়তার সময় মুক্তি পাওয়ায় দর্শক যদি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ গোত্রের রসিকতা আশা করে এ ছবি দেখতে যান ভুল হবে। কারণ পরিচালক ‘সিরিয়াস’ ভঙ্গিতে মরণের ওপারের জীবন সন্ধান করেছেন। সন্ধ্যান করেছেন এই ভুবনের বাইরে অন্য কোনও ভুবনের। যদি থেকে থাকে সেখানে জীবনের আর্তি কতটা সত্যি, এই সব। যারা ম্যাজিক রিয়েলিজম বা স্থান কাল পাত্র, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বিভ্রম ঘটানো যাদু বাস্তবতার গল্প বা ছবি ভালবাসেন তাদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে এই ছবি। চলতি ছবির ধারায় একেবারে অন্যরকম একটা গল্প ভেবেছেন পরিচালক। স্বাদ গন্ধে টক ঝাল মিষ্টি সুখাদ্যের মৌতাত আনতে চেয়েছেন। তবে তা একেবারেই যাদুবাস্তব-প্রিয় দর্শকের জন্য।
মায়াবাজার
রূপা, ধৃতিমান, প্রদীপ, বাদশা, দীপাঞ্জন, পায়েল
মোট তিনটি গল্প নিয়ে তৈরি এ ছবিতে পরিচালক গা ছমছমে ভূতের গল্পের অনুভূতি তৈরি না করে কোথাও রেখেছেন মৃত্যুর ওপারে হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য ব্যাকুল বেদনা, কোথাও বা যুক্তি তর্ক বুদ্ধি দিয়ে দেহাতীতেত অন্বেষণ নিয়ে চাপানউতর। এবং এই কাজগুলি করতে তিনি ছবিকে শিল্পিত ভাবে নিয়ে যেতে চেয়েছেন ফ্যান্টাসির ক্যানভাসে।
স্মৃতি: প্রথম গল্প শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘দেহান্তর’ এর ছায়ায়। মুখ্য চরিত্র রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। অত্যন্ত ‘প্যাশনেট’ সম্পর্কে বাঁধা পড়ে থাকা দাম্পত্যের মায়া কাটিয়ে স্বামী চলে যাওয়ার পর রূপার সম্বল নিরবিচ্ছিন্ন একাকিত্ব। আর স্মৃতি। স্বামী বাদশা মৈত্র চলে গিয়েও চলে যান না। রূপার অদম্য আকর্ষণে ফিরে ফিরে আসেন বিভিন্ন পুরুষের দেহ ও আত্মার ভেতর দিয়ে। এই খানেই গল্পের চমক। যা ছবি দেখলেই একমাত্র বোঝা যাবে। গল্প বলার ভঙ্গিতে রয়ে গেছে অজস্র মুহূর্ত যেখানে প্রায়ই এলোমেলো হয়ে যায় কোনটা বাস্তব কোনটা অবাস্তব। পরিচালকের কৃতিত্ব এখানেই। তিনি একটি সরল রেখায় গল্প বলে গিয়েছেন, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎকে বিচ্ছিন্ন করেননি অহেতুক জটিলতায়। বেশ থ্রিলার শৈলীতে পরিবেশিত হয়েছে প্রথম গল্পটি। নরনারীর শরীরী মিলনের দৃশ্যগুলি নান্দনিক। মৃত স্বামীর সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা বলার অতীন্দ্রিয় মুহূর্তগুলো রূপা বড় করুণ ভাবে ফুটিয়েছেন। বাদশা মৈত্রের প্রায় নীরব উপস্থিতি তাঁর অভিনয়ে রোমাঞ্চের মাত্রা যোগ করে। রূপার বন্ধু হিসেবে কৃষ্ণকিশোর মুখোপাধ্যায় স্বতঃস্ফুর্ত, প্রাঞ্জল। তিনি এই গল্পের একটি আলাদা আকর্ষণের জায়গা তৈরি করেন, কারণ পুরো গল্পটা বলছেন তিনিই।
সত্তা:
‘শূন্য শুধু শূন্য নয়’- এ গল্পটিও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরিচালক দুটি গল্পেই মূল লেখার ছায়ামাত্র নিয়ে চিত্রনাট্য লেখার চেষ্টা করেছেন। সিনেমার নিজস্ব ভাষা, তা এই গল্পটিতেই সবচেয়ে ভাল ভাবে ফুটেছে। এ ছবির নায়ক শিল্পী দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য অনেক অপেক্ষার পর তার মানসসুন্দরীকে খুঁজে পায় এমন এক নারীর (পায়েল দে) মধ্যে যে আর এ পৃথিবীতে নেই। তার ছবি আঁকার জগতের সঙ্গে মিলে মিশে যায় সেই মানসীর অশরীরী উপস্থিতি। অবশ্য অন্য সকলের কাছে সেই মেয়ে বাস্তবে অনুপস্থিত হলেও দীপাঞ্জন তাকে নিজের মতো করে এক জগৎ তৈরি করে আপন করে নেয়। এই গল্পে মাঝে মাঝে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়ের কবিতা থেকে বেছে বেছে নেওয়া এমন সব পংক্তি আছে যেখানে জুড়ে আছে মায়াবাস্তবের অনুষঙ্গ। শ্রুতিমধুর হয়েছে ‘মনের মানুষের খোঁজে’ বাউল গান। পরিবেশনার দিক থেকে জয়দীপ সবচেয়ে বেশি রোম্যান্টিক এই গল্পেই। এই রোম্যান্টিকতা দর্শকের ভাল লাগতে পারে।
ভবিষ্যৎ: এখানেও তাই। পরশুরামের লেখা ‘মহেশের মহাযাত্রা’ গল্পের ছায়ায় চিত্রনাট্য লিখে জন্ম মৃত্যু নিয়ে আশ্চর্য বিভ্রম বা ইলিউশন তৈরির চেষ্টা করেছেন জয়দীপ। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই যে শেষ কথা, পুরো ছবিটি এই উপসংহারে পৌঁছায় এই গল্পের মাধ্যমেই। মৃত্যর পর আর কোনও জীবন আছে কি নেই, এই নিয়ে বিস্তর যুক্তি তর্কের জাল বোনেন দুই অধ্যাপক। একজন দর্শনের। অন্য জন বিজ্ঞানের। অনেকদিন বাদে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ও প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে এই দুই চরিত্রে দেখে বেশ নস্টালজিক লাগে। দু’জনেই চমৎকার অভিনয়ে। কিন্তু জন্ম মৃত্য নিয়ে, অস্তি নাস্তি নিয়ে আলোচনার মাঝখানে আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ এসে পড়ার দৃশ্যটি ভাবনা হিসেবে মজার হলেও উপস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। ছবির গতিও অকারণে ধীর হয়ে গিয়েছে এই গল্পে। বড্ড বেশি সংলাপের ভিড়ভাট্টা। তাই একঘেয়েমি এসে যায়। অলৌকিকের ছোঁয়াও পায়নি এ অংশ। অবশ্য পরিচালক যদি আধিভৌতিকতা বাদ দেওয়ার জন্যই এত সংলাপ রেখে থাকেন তবে সেটা আলাদা কথা। এই গল্পটি কেমন যেন অতিমাত্রায় থিয়োরি নির্ভর।
যাদু বাস্তবতার মেজাজকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই ছবির শিল্প নির্দেশনা (গৌতম বসু) ও বা সিনেমাটোগ্রাফির (প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী)। নতুন ধরনের ভাষায় নতুন ঢংয়ে গল্প বলার চেষ্টা করেছেন জয়দীপ। সেটাই এই ছবির প্রাপ্তি। তবে প্রথম দুটি গল্পে যে টান আছে শেষেরটিতে তা রইল না, হল থেকে বেরিয়ে এই অনুভূতিটাই খচখচ করে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.