|
|
|
|
প্রচার-পরিক্রমায় হলদিয়া |
নির্বিঘ্নে ভোটগ্রহণই এখন প্রার্থনা পুরবাসীর |
দেবমাল্য বাগচি • হলদিয়া |
বছর কয়েক আগেও সিপিএম নেতা লক্ষ্মণ শেঠের ‘দাপটে’ হলদিয়ায় কোনও ভোটের প্রচারেই পাত্তা পেত না বাম-বিরোধীরা। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পরে পঞ্চায়েত, লোকসভা থেকে বিধানসভা নির্বাচনে সেই ছবি ক্রমশ বদলেছে। পালাবদলের পরে পূর্ব মেদিনীপুরে সর্বত্রই এখন তৃণমূলের আধিপত্য। এই পরিস্থিতিতে জেলায় বামেদের দখলে থাকা একমাত্র পুরসভা হলদিয়াতেও ভোট-প্রচারে বামেদের তুলনায় কয়েকশো যোজন এগিয়ে তৃণমূলই।
নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ডে জড়িয়ে লক্ষ্মণ শেঠ আপাতত জেলবন্দি। লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী অশোক পট্টনায়েকের মতো অনেকেই দল থেকে বহিস্কৃতও হয়েছেন। আবার শেখ মুজফ্ফরের মতো বিদায়ী বোর্ডের সিপিএম কাউন্সিলরও শিবির বদলে ফেলেছেন। এ হেন ‘বিধি বাম’ পরিস্থিতিতে বিদায়ী পুরপ্রধান তথা সিপিএম জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তমালিকা পণ্ডাশেঠ নিজের ‘মর্যাদা’ ও দলের ‘অস্বিত্ব’ রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন। তবে একদা ‘হলদিয়াপতি’ লক্ষ্মণ শেঠের অভাব অনেকটাই ফিকে করে দিচ্ছে এই লড়াইকে। তমালিকাদেবীর নিজেও বলেন, “উনি নেই, সেই অভাব তো আছেই। তবে সেটা একটা জেদ, দায়বদ্ধতা তৈরি করেছে।”
বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই লক্ষ্মণ শেঠের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘আইকেয়ার’ পরিচালিত মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন নিয়ে টানাপোড়েনেও অস্বস্তি বাড়ছিল দলের। তাঁর উপরে লক্ষ্মণবাবুর জেলবন্দি হওয়া, একের পর এক ডামাডোলে বিপর্যস্ত হলদিয়ার সিপিএম শিবির। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে আসতেও নারাজ বহু সিপিএম কর্মী-সমর্থক। এ বারের পুর-নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার পর থেকেই কার্যত ‘কোণঠাসা’ দেখাচ্ছে সিপিএম প্রার্থীদের। প্রকাশ্য সমাবেশ দেখা যায়নি কাউকেই। কিছু ওয়ার্ড ছাড়া দেওয়াল লিখন বা পতাকাও চোখে পড়ছে না বিশেষ। যতটুকু যা প্রচার, তা শাসক তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধেই। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী তমালিকাদেবীর কথায়, “যতটা সম্ভব প্রচার করছি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে। মানুষের সাড়া মিলছে। প্রকাশ্য-প্রচারে তো তৃণমূল সর্বত্র বাধা দিচ্ছে। পতাকা ছিঁড়ে দিচ্ছে। আমি কর্মীদের কোনও রকম সংঘাতে না যাওয়ারই অনুরোধ করেছি।” বস্তুত, পুরভোটের প্রচারে সিপিএমের হেভিওয়েট নেতাদেরও বিশেষ দেখা মেলেনি এ বার। শেষ বেলায় অশোক ভট্টাচার্য, মহম্মদ সেলিমরা অবশ্য দু’একটি সভা করেছেন।
যেখানে তৃণমূল প্রতিটি ওয়ার্ড ধরেই সভা করছে। অধিকাংশ সময়েই সেই সভায় উপস্থিত থাকছেন শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়ের মতো শীর্ষ-নেতারা। এ বার নির্বাচনে হলদিয়ার ২৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে সব ক’টিই তাঁদের দখলে আসবে বলে দাবি করছেন তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু। নীরবে থেকে কি তৃণমূলের এই আগ্রাসী প্রচারের জবাব দেওয়া যাবে? নিজের উপরে আস্থা রেখে তমালিকাদেবী বলেন, “আমি লড়াইয়ে আশাবাদী। লড়াইয়ের লক্ষ্য জয়। তবে, আমি জ্যোতিষী নই। গত ১৫ বছরে নাগরিক সনদ মেনে যা কাজ করার করেছি। যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে।” তবে পানীয় জলের সমস্যার কথাও মেনে নিয়েছেন পুরপ্রধান। হলদিয়ায় টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন বামেরা। প্রথম ১০ বছরে তারা ছিল নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তবে, ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রাম ‘গণহত্যা’র পরের পুরভোটে ২৬টির মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডে জিতে পুরসভায় প্রবেশ করে তৃণমূল। নন্দীগ্রাম থেকেই বিপর্যয় চলছে বামেদের। এই মুহূর্তে জেলার ৫টি পুরসভার ৪টিই তৃণমূল বা কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের দখলে। একমাত্র হলদিয়াই ব্যতিক্রম। সেই ব্যতিক্রম মুছতে মরিয়া শাসকদল। লক্ষ্মণ শেঠের জেলে থাকার সুযোগটাও তারা পুরো কাজে লাগাচ্ছে। তমালিকার মতোই তৃণমূলের কাছেও হলদিয়া ‘প্রেস্টিজ ফাইট’।
কলে-কারখানায় ভরা এই শহরে তৃণমূলের সংগঠন বলতে মূলত শ্রমিক-সংগঠন। পুরভোটে তাদের প্রচার-সভাতেও ভিড় জমাচ্ছে মূলত কারখানা-ফেরত শ্রমিকরাই। সেই সঙ্গেই লাগাতার চলছে পদযাত্রা, মোটরবাইক মিছিল। তবে গোষ্ঠী-কোন্দলে কিছুটা বিব্রতও প্রধান শাসকদল। তাঁর মনোনীত প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক না-পাওয়ায় বিদ্রোহের সুর শোনা গিয়েছে এমনকী দলের বিধায়ক শিউলি সাহার মুখেও। বিড়ম্বনা বেড়েছে শুভেন্দু-শিবিরের। এ দিকে জোট ভেঙে যাওয়ায় কংগ্রেস এ বার ২৬টির মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডেই লড়ছে। তারাও সমান ভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছে। তাদের প্রচারে ‘হেভিওয়েট’ নেতারাও এসেছেনঅধীর চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সি, মানস ভুঁইয়া, প্রদীপ ভট্টাচার্যরা। কংগ্রেস প্রার্থীদের জেতানোর আর্জিও জানাচ্ছেন তাঁরা। এমনকী বিজেপি-ও এ বার কোমর বেঁধে নেমেছে। প্রার্থী দিয়েছে ১৮টি ওয়ার্ডে। সাধ্যমতো প্রচারও করছে। বামবিরোধী ভোট-ভাগ হওয়ার আশঙ্কা ঈষৎ উদ্বেগ তৈরি করছে তৃণমূল-শিবিরে। তবে শুভেন্দুর দাবি, সন্ত্রাস নিয়ে মিথ্যা প্রচার চলছে। সন্ত্রাস হলে মহম্মদ সেলিম, অশোক ভট্টাচার্য, কংগ্রেস নেতারা সভা করলেন কী ভাবে? অপপ্রচারের জবাব দিয়েই জিতব।”
হলদিয়ার সাধারণ মানুষ আপাতত রবিবার সন্ত্রাস-মুক্ত ভোটগ্রহণই চাইছেন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অমিত বৈতালিকের কথায়, “প্রচার ঘিরে যা চলছে, তা ঠিক নয়। সমস্ত রাজনৈতিক দল সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখুক। শান্তি বজায় রেখে নিরপেক্ষ ভাবে ভোটদানের সুযোগ চাইছি। শান্তি না থাকলে উন্নয়নই বা হবে কী ভাবে?” |
|
|
|
|
|