ফিশারের থেকে বেশি কৃতিত্ব দেব তৃতীয় বিশ্বের আনন্দকে
মি তোমায় ভালবাসি, দীপু।
বিশ্বনাথন আনন্দকে যদি এক্ষুনি ফোন করি, ও এই কথাই বলবে। বয়সে তিন বছরের ছোট হলেও আনন্দ আমাকে বরাবর নাম ধরে ডাকে। টানা চার বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিল। মস্কোতে ইজরায়েলের বরিস গেলফাঁ-কে হারিয়ে বুধবার পঞ্চম বার বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব পেল ও। অসাধারণ বললে কম বলা হয়!
সেই বিরানব্বইয়ে কলকাতায় গুডরিক ওপেনে ওর সঙ্গে শেষ বার খেলেছিলাম। তার পরে সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের মানের কোনও টুর্নামেন্ট এ দেশে না হওয়ায় ঘরোয়া দাবায় আর খেলতে দেখা যায়নি ওকে। আমার সৌভাগ্য যে, আনন্দের সঙ্গে শেষ গেমটাও ড্র করতে পেরেছিলাম। ওই সময় আনন্দ বেশ কয়েক দিন কলকাতায় থাকায় কিছু কিছু বাংলা শিখেছিল। আমিও ওকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গোছের বাংলা শিখিয়েছিলাম। তার পর থেকে দেখা হলেই আনন্দ ‘তোমায় ভালবাসি’ বলবেই!
দু’বছর আগে টোপালভকে হারিয়ে আনন্দ যখন চতুর্থ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়, সর্বভারতীয় দাবা ফেডারেশন (যার আমি বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট) ওকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। সেখানেও দেখলাম, বাংলা কথাগুলো ভোলেনি। মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল গত বছর কলকাতায় সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের (যে এখন আনন্দের অন্যতম ‘সেকেন্ড’) বিয়ের রিসেপশনেও। সেটাই আপাতত শেষ দেখা।
ছবি: এপি, এএফপি
আনন্দরা অদ্বৈতবাদী আইয়ার ব্রাহ্মণ। জন্ম থেকেই খুব ঠান্ডা স্বভাবের। সুখ-দুঃখ সব রকম অবস্থাতেই একই রকম মুখচোখ। দাবার বোর্ডে আনন্দ বরাবর তাই। টাইব্রেকে সব সময় দুরন্ত। এ দিন যখন ও টাইব্রেকে শুরু করল, তখনই আমি জানতাম, ও জিতবে। গেলফাঁ-র ওকে আটকানোর ক্ষমতা ছিল না। শান্ত মেজাজেই আনন্দ সামলে নিল শেষটা। তবে শান্ত মেজাজের ভেতরে দুষ্টুমিও দেখেছি আনন্দের। গ্রিসে আমাদের টিম ম্যানেজারকে রাতদুপুরে হোটেলের ঘর থেকে ভুয়ো ফোনে ডেকে পাঠিয়ে রিসেপশনে মিথ্যে মিথ্যে বসিয়ে রেখেছিল। আনন্দ এ রকম মজা করত। অন্যরা বলত, এ সব বড়ুয়ার বুদ্ধি।
আমাদের পরিচয়ের শুরু দিল্লিতে, তিরাশির হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়। তত দিনে জাতীয় সাব-জুনিয়র, জাতীয় জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত দাবাড়ু। দিল্লিতেও জুনিয়র টুর্নামেন্টে আমি হট ফেভারিট। কিন্তু থাকতাম একটা ধর্মশালায়। আরও তিন-চার জন দাবাড়ুর সঙ্গে একটাই ঘরে মাটিতে বিছানা পেতে। আনন্দ তখনই আলাদা হোটেলে ওর মায়ের সঙ্গে উঠেছিল। সুন্দর দেখতে একটা বছর চোদ্দোর ছেলে। মাথায় টুপি। বোর্ডে একটা করে চাল দিচ্ছে আর পরক্ষণেই উঠে পড়ে অন্য বোর্ডের গেমগুলো লক্ষ করছে। আনন্দকে চাল দিয়ে বোর্ডে বসিয়ে রাখতে পারাই অন্যদের কাছে একটা বিরাট প্রাপ্তি ছিল।
আমাদের দু’জনের প্রথম লড়াইয়ে পঁচাশিতে জাতীয় জুনিয়র দাবায় ওকে হারিয়েছিলাম। সেখানে আমি ৯-এ ৯ করে চ্যাম্পিয়ন হলেও আনন্দের উদ্ভাবনী চালগুলোই বেশি আগ্রহ তৈরি করেছিল দর্শকদের ভেতর। ছিয়াশিতে দাবা অলিম্পিয়াডেও ওকে হারিয়েছিলাম, কিন্তু অষ্টাশিতে গ্রিস দাবা অলিম্পিয়াডে আনন্দকে অন্য চেহারায় আবিষ্কার করলাম। সে বার আমরা রুমমেট। তার আগের বছরই ও গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছে। তার পরপরই মাদ্রিদে বাসা বেঁধেছে। আমার মতে, এটাই ওর দাবা-জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। প্রায় ভারতীয় আদব কায়দার ওই স্প্যানিশ শহরটা অর্থনৈতিক ভাবে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনই দাবা-চর্চার জন্য বিখ্যাত। আনন্দের বাবা সাদার্ন রেলের জিএম হওয়ায় ছেলেকে বিদেশে রাখার মতো আর্থিক স্বচ্ছল ছিলেন। রাশিয়া কিংবা পোলগার বোনেদের সঙ্গে প্র্যাক্টিস করার জন্য পোল্যান্ডে যাওয়ার অফার এলেও যেটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
গ্রিসে দু’জনে এক ঘরে থাকার সুবাদে আনন্দের একাগ্রতা, শেখার অফুরান ইচ্ছে, জেতার ভয়ঙ্কর খিদে আর ঠান্ডা মেজাজের সঙ্গে আমার আরও ভাল করে পরিচয় ঘটেছিল। আমি মনে করি, আনন্দ এই জায়গায় একেবারে তেন্ডুলকরের মতো। ওরও ২২-২৩ বছর ধরে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আর সাফল্যের মূল স্তম্ভ ওই চারটে জিনিস। এক দিন রাত দু’টোয় ঘুম ভেঙে দেখি দাবার জনপ্রিয় বই ‘ইনফরম্যাটার’ পড়ছে আনন্দ। স্রেফ চালগুলো মুখস্থ করে যাচ্ছে পাতার পর পাতা। গ্রিসে আমি গোল্ড মেডেল জিতেছিলাম। কিন্তু আমাকে সেকেন্ড বোর্ডে দুর্দান্ত ভাবে ব্যবহার করার কৃতিত্ব দলের ক্যাপ্টেন আনন্দেরই। নির্দ্বিধায় বলব, ববি ফিশারের থেকেও আনন্দের কৃতিত্ব বেশি। কারণ, তৃতীয় বিশ্ব থেকে ও-ই দাবায় রুশদের একাধিপত্যে শুধু আঘাতই হানেনি, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটার মতোই ভেঙে টুকরো করে দিয়েছে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.