মিলটন ফ্রিডম্যান বহু পূর্বেই বিশ্বজয় করিয়াছিলেন। এই নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রী বহু কারণে স্মরণীয়। কিন্তু, আধুনিক অর্থনীতিতে তাঁহার প্রধান গুরুত্ব, তিনি বিংশ শতকে বাজার অর্থনীতির তত্ত্বের প্রধানতম পুরোধা। ত্রিশের দশকের মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জোড়া ধাক্কা অতিক্রম করিয়া অর্থনীতি যখন ক্রমে রাষ্ট্রনির্ভর যন্ত্রে পরিণত হইতেছিল, ফ্রিডম্যান সেই যুগে বাজারের পতাকা তুলিয়া ধরায় অদম্য ছিলেন। তাঁহার সেই আর্থিক তত্ত্ব সম্বন্ধে গোড়ায় হাজার সংশয় ছিল। কিন্তু, একবিংশ শতকের দুনিয়ার দিকে এক নজর তাকাইলেই স্পষ্ট হয়, তাহা মিলটন ফ্রিডম্যানেরই মানসপ্রতিমা। বাজারের অনস্বীকার্যতাকে প্রশ্ন করিবার অবান্তর প্রয়াস এখন আর কেহ করেন না। আর্থিক দুনিয়ায় বাজারই একমাত্র স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাহাকে ফ্রিডম্যানের বিশ্বজয় আখ্যা দিলে তাহা বহু পূর্বেই পূর্ণ হইয়াছে। ফ্লোরিডার মহাকাশযান প্রক্ষেপণ কেন্দ্র হইতে একটি বেসরকারি সংস্থার রকেট মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে মিলটন ফ্রিডম্যানের মহাবিশ্বজয়ও সম্পন্ন হইয়া গেল। মহাকাশ বস্তুটি সর্বজনীন হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে রাষ্ট্র তাহাকে প্রাণপণে আগলাইয়া রাখে। কেন, তাহার সূত্রটি ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ইতিহাসে মিলিবে। কিন্তু, তাহা ইতিহাসমাত্র। নাসা-র তত্ত্বাবধানে এই বেসরকারি মহাকাশযানটির উৎক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্র এবং বাজারের মধ্যবর্তী একদা অলঙ্ঘ্য প্রাচীরটি ধসিয়া পড়িল। এবং, তাহাই স্বাভাবিক। বস্তুত, অনিবার্য। রাষ্ট্রের আজ আর সেই মহিমা নাই। আধুনিক অর্থনীতি রাষ্ট্রের পরিসরকে সংক্ষেপ করিয়া দিয়াছে। ফলে, আজ রাষ্ট্র যে ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিতে চাহিবে, বাজারের প্রতিস্পর্ধা না মানিয়া তাহার উপায় থাকিবে না। মহাকাশবিজ্ঞানের দরজাটি বাজারের জন্য খুলিয়া যাওয়া একটি বিপ্লব। লক্ষণীয়, এই বিপ্লবে রাষ্ট্রও শরিক। যে বেসরকারি সংস্থা এই মহাকাশযানটি পাঠাইয়াছে, তাহাকে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সাহায্য লইতে হইয়াছে। ইহাই বাঞ্ছনীয়। রাষ্ট্র বাজারকে যথাসম্ভব সহায়তা করিবে, এবং তাহার মাধ্যমে এমন একটি অতিক্রিয়া সৃষ্টি করা সম্ভব, যাহা সমাজের পক্ষে সর্বাধিক মঙ্গলের হইবে। স্মর্তব্য, কথাটি শুধু মহাকাশবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নহে।
যে প্রশ্নটি অতঃপর অনিবার্য হইয়া উঠে, তাহা হইল বেসরকারি বিনিয়োগ কি সমাজের স্বার্থে, জনস্বার্থে কাজ করিতে পারে? ভারতের রাজনীতিকরা এই প্রশ্নটির নেতিবাচক উত্তর দিবেন। উত্তরটি ভুল হইবে। বেসরকারি বিনিয়োগের প্রতি অভক্তির একটি প্রধান কারণ তাহার মুনাফা করিবার লক্ষ্য। যাহার একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা, তাহা জনস্বার্থে কাজ করিতে পারে না প্রচলিত বিশ্বাসে এই কথাটি প্রোথিত হইয়া আছে। প্রচলিত বলিয়াই বিশ্বাসটি অভ্রান্ত, এমন ভাবিবার কোনও কারণ নাই। তেঁতুলপাতা খাইয়া বুনো রমানাথের জুতায় পা না গলাইতে পারিলে জনস্বার্থ রক্ষা করা যায় না, কে বলিল? যে সংস্থাটি এই মহাকাশযানটি নির্মাণ করিয়াছে, তাহাকে মহাকাশে পাঠাইয়াছে, সন্দেহ নাই, মুনাফাই তাহার লক্ষ্য। কিন্তু, মানবকল্যাণকে পাশ কাটাইয়া কি সেই মুনাফা অর্জন করা সম্ভব? রাষ্ট্র মহাকাশযান পাঠাইলে সাধারণ্যের যে উপকার হয়, বেসরকারি সংস্থা পাঠাইলেও তাহার ইতরবিশেষ হইবে না। কেহ বলিতে পারেন, বেসরকারি সংস্থাটি এই উপকারের বিনিময়ে কড়ি গনিয়া লইবে। রাষ্ট্র কি তাহা লয় না? প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ করের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ রাজকোষে যে অর্থের সংস্থান করে, তাহা হইতেই এই মহাকাশ অভিযানের খরচ চলে। ভারতেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। সরকার যে টাকা ব্যয় করে, তাহা সরকারের ‘ব্যক্তিগত’ হইতে পারে না। তাহা মানুষেরই টাকা। ফারাক কেবল ইহাই যে রাষ্ট্র পূর্বে মূল্য গনিয়া লইয়া পরে পরিষেবা দেয়, বাজার তাহার বিপরীত চালে চলে। বাজারের সহিত যে চরিত্রগত ভাবে জনস্বার্থের বিরোধ নাই, এই কথাটি বুঝিবার এবং স্বীকার করিবার সময় আসিয়াছে। মিলটন ফ্রিডম্যান অমর হউন। |