ঋজু বসু ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
কে বলবে ইডেনে হয়নি খেলাটা!
গ্যালারি না-হোক, স্টেডিয়ামের সম্প্রচার কক্ষে গাদাগাদি করা শ’দুয়েক লোকের চিল-চিৎকারে ভ্রম হতে বাধ্য। গম্ভীর আউট হওয়ার পরে মুষড়ে পড়ে যাঁরা ওই ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছেন বা টিভি-র চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়েছেন, রবিবারের এই রাতটার জন্য তাঁদের আফসোস সহজে মিটবে না।
জায়ান্ট স্ক্রিনে চিদম্বরম স্টেডিয়ামের এক-একটি মুহূর্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরভর্তি জনতা কখনও পাগলের মতো হাততালি বা সিটি দিচ্ছে, কখনও বা টেনশনে বাক্যিহারা। নো-বলে সাকিব ফিল্ডারের হাতে ধরা পড়ার মুহূর্তে প্রথমটা সব শেষ ভেবে সব ক’টা মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আম্পায়ারের হাতের ইশারায় জনতা যেন প্রাণ ফিরে পেল। রুদ্ধশ্বাস ক্লাইম্যাক্সে উত্তেজনার পারদ ঘনঘন ওঠানামার শেষে গোটা শহরটাই আত্মহারা হয়ে রাজপথে নেমে পড়ল। রাত ১২টার রাসবিহারী অ্যাভিনিউ আটকে কেকেআর-ভক্তদের বিরাট মিছিল। সঙ্গী মেগাসাইজ বেগুনি পতাকা আর জয়ের নায়কদের ফ্লেক্স।
|
মধ্য কলকাতার ফুটপাথে ভিড় জমিয়েছেন উৎসাহীরা। — নিজস্ব চিত্র |
আবেগের সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেহালায় ‘দাদার পাড়া’ থেকে কালীঘাটে ‘দিদির গলি’ পর্যন্ত। রাত সাড়ে ১২টায় হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে কালীঘাট মিলন সঙ্ঘের সামনে বাজির শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। বেহালায় সৌরভের বাড়ির গলির সামনে কেকেআর-ভক্তদের জটলায় বাংলার সরকারি ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ শাহরুখের নামে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি। পার্ক স্ট্রিটে রাত ১২টায় আচমকা নাইট ক্লাবে ঢুকতে মরিয়া আবদার তরুণ-বাহিনীর। যদুবাবুর বাজারের সামনে রাজপথে তুবড়ির উল্লাস। ভিআইপি রোড জুড়ে ঢোল হাতে খ্যাপাটে নাচের ছন্দ। টিমের পতাকা না-থাকুক, বেলগাছিয়ায় কেকেআর-ভক্তদের মিছিলে জাতীয় পতাকা আর কিং খানের ছবি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির অফিস অন্তত রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকাটাই রেওয়াজ। আইপিএল জয়ের আনন্দের সাক্ষী থাকতে সেখানেও বাড়তি ঘণ্টা দেড়েকের ওভারটাইম। কাছেই প্রহরারত পুলিশকর্মীরা পর্যন্ত ঘনঘন ওই ঘরে উঁকি মেরে টিভি থেকে স্কোর জেনে নিচ্ছিলেন। ঘরের ছেলে মনোজ ‘ম্যাচ ফিনিশ’ করতেই অফিসের কর্মীরা তাঁদের খবরটা দিতে ছুটলেন।
নিউ আলিপুর, টালিগঞ্জ, ব্রহ্মপুরের ক্লাবে ক্লাবে দল বেঁধে খেলা দেখা কেমন জমল, ম্যাচের শেষে চেন্নাই থেকে খোঁজ নিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ম্যাচ জিতিয়ে গভীর রাতে বীরের মতো ভবানীপুরে নিজের পাড়ায় ফিরলেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। ফাইনালটা আগাগোড়া ইডেনে বসেই দেখেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী। কালিস-বিসলার অবিশ্বাস্য পার্টনারশিপের সময় এক খুদে ক্রিকেট শিক্ষার্থীকে সরিয়ে এক পরিচিত তাঁর পাশে বসতে যেতেই আঁতকে উঠলেন মন্ত্রী: “এ কী করছেন! প্লিজ, জায়গা থেকে নড়বেন না! ভালয় ভালয় সবটা শেষ হতে দিন।” শেষটা কী হতে চলেছে, তা নিয়ে অবশ্য শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল সংশয়। ‘নাহ্, পরিবর্তনটা এ বারেও হল না!’ |
অকাল দীপাবলি। জয়ের পরে ইডেনের সামনে। রবিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের শপিংমলে জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে চাপা গুঞ্জন ভেসে এসেছিল গম্ভীর আউট হওয়ার পরেই। ইউসুফ পাঠান আউট হওয়ার পরে টিভি-র পর্দায় ট্রফির ক্লোজ-আপ দেখে ইডেনের জনতার দীর্ঘশ্বাস: ‘কত কাছে, তবু কত দূর’! প্লাস্টিকের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো মুখগুলোকে তখন বাবার কোমর জড়িয়ে ‘সন্ত্রস্ত’ শাহরুখ-কন্যা সুহানার মতোই অসহায় দেখাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত ও-পারের সাকিব এবং এ-পারের মনোজ দুই বাঙালির হাত ধরে জয় আসতেই জনতা আত্মহারা হয়ে উঠল। জামাইষষ্ঠীর রাতে শহরের অন্যতম বিখ্যাত জামাইয়ের প্রতিও যে কলকাতা এতটা নির্দয় হবে, তা-ই বা কে ভেবেছিল! টিভি-তে চেন্নাই-ক্যাপ্টেন ধোনির থমথমে মুখ দেখেও শহরের ‘চিয়ার’ থামার লক্ষণ নেই। শুধু আইপিএল জয় নয়। পরের বার ইডেনে উদ্বোধনী ম্যাচ ও ফাইনাল দু’টোই ছিনিয়ে আনার আনন্দ তখন বড় হয়ে উঠেছে।
|