কলকাতা নাইট রাইডার্স থেকে কলকাতার পুনর্জন্ম!
বাঙাল না ঘটি, সেটা কিছু নয়। ক্রিকেটের ভক্ত না ফুটবল, সেটাও কিছু নয়। এমনকী ফিকে হয়ে গিয়েছে টিমে বাঙালি ক’জন সেই প্রশ্নটাও। কারণ, কলকাতা নাইট রাইডার্স আর শুধু একটা ক্রিকেট টিম নয়। হয়ে উঠল কলকাতা শহরের নিশান। ‘ব্র্যান্ড’ কলকাতার নতুন অভিজ্ঞান!
অতএব? কলকাতা চেঁচাল কলকাতার জন্য। সম্ভবত এই প্রথম।
শোনা যায়, স্বাধীনতার আগের যুগে এক বার সবাই চিৎকার করেছিল ১৯১১-র ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড ফাইনালে। কিন্তু ‘শিবে-বিজে’র সেই মোহনবাগান ছিল ব্রিটিশ-বিরোধী আবেগের প্রতীক। সেটা শুধু কলকাতার ব্যাপার নয় কোনও মতেই। তার পরে জিকো-র জাপানের বিরুদ্ধে ভাইচুংয়ের দলের হয়ে যুবভারতী একযোগে চিৎকার করেছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভারতের জন্য জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে তিনশো বছর পেরোনো শহর। কিন্তু সে তো দেশের জন্য, ঘরের ছেলের জন্য। কলকাতার জন্য গলা ফাটানোর সুযোগ এর আগে পেল কোথায় কলকাতা?
ফুটবলকে ঘিরে তো কলকাতা ভাগ হয়ে যায়! প্রতি বছর চার-পাঁচটা দিন লাল-হলুদ বা সবুজ-মেরুন পতাকা ভাগ করে দেয় শহর থেকে শহরতলি। গলি থেকে রাজপথ। কলকাতা দেখেছে পেলে-মারাদোনা-মেসিকে। জিকো, কান, ফ্রাঞ্চিকোলি, বুরুচাগাকে। যিনিই এখানে এসেছেন, কলকাতার প্রশংসা করেছেন। উচ্ছ্বসিত হয়েছেন কলকাতার ক্রীড়াপ্রেম দেখে। কিন্তু যে শহরের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ, তার তো নিজের টিমই ছিল না এত দিন! রবিবার কিন্তু একই রংয়ের পতাকা উড়ল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দুই পাড়াতেই। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দু’দলের সমর্থকই পাশাপাশি বসে একসঙ্গে চিৎকার করলেন, রাসবিহারী থেকে শ্যামবাজার।
অতএব?সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো চির-বর্ণময় চরিত্রকেও অন্তত এক দিনের জন্য পিছনে ফেলে দিলেন গৌতম গম্ভীর। ভাইচুং ভুটিয়া এক দিনের জন্য ম্লান হয়ে গেলেন জনপ্রিয়তায় কয়েক যোজন পিছনে থাকা লক্ষীরতন শুক্ল-দেবব্রত দাসের কাছে। ‘শার্পনেল’ শিশির ঘোষ ডার্বি ম্যাচে গোল করার পর যে চিৎকার উঠত শহর জুড়ে, তার চেয়েও বেশি আওয়াজ উঠল রবিবার রাতে। শহরের জন্য আবেগের কি এক নতুন অধ্যায় তৈরি হল চেন্নাইয়ের আইপিএল ফাইনাল থেকে?
“বাংলার হয়ে খেলেছি, দেশের হয়ে, ক্লাবের হয়ে। কলকাতার হয়ে তো খেলিনি কখনও,” আক্ষেপ ঝরে পড়ে শিশির ঘোষের গলায়। শ্যাম থাপার গোলে ’৭৮-র কলকাতা লিগ ডার্বি জেতার পর জনতার কাঁধে চেপে বাড়ি ফিরেছিলেন সুব্রত। কিন্তু ফেরার সময় এক দল লোককে গালাগালি দিতেও দেখেছিলেন। তারা অন্য দলের সমর্থক। শ্যাম থাপার অসাধারণ বাইসাইকেল কিক দুঃখ দিয়েছিল শহরের একটা অংশকে। কলকাতা জুড়ে বন্দিত হয়নি। ’৯৭-এর ফেড কাপ সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল জার্সি পরে হ্যাটট্রিকের পর কলকাতার বহু মোড়ে ছবি টাঙিয়ে পুজো হয়েছিল ভাইচুংয়ের। কিন্তু সে বারও শহরের একটি অংশ দুঃখে নুইয়ে ছিল। কারণ তাঁরা ছিলেন বাগান-সমর্থক।
খেলার মাঠে এত দিন কলকাতার ক্লাব সংস্কৃতি আবর্তিত হত তিন প্রধান ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান বা মহমেডানকে ঘিরে। ফ্র্যাঞ্চাইজির টিম হলেও নাইট রাইডার্স তো আসলে কলকাতার ক্লাব। চেন্নাই থেকে তবে কি ক্লাব সংস্কৃতির নতুন যুগও শুরু হল? “আসলে নতুন প্রজন্ম এ রকম একটা টিম চায়। শহর বা রাজ্যের টিম। বাংলার সব লোক যাকে ঘিরে উদ্বেলিত হবে,” বলছিলেন ভাইচুং ভুটিয়া। যে রকমটি হয় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বা রিয়াল মাদ্রিদকে ঘিরে।
আগের বছরগুলোয় খুব বেশি এগোতে পারেনি কেকেআর! এই প্রথম ফাইনালে ওঠার পর থেকেই নাইট রাইডার্সের হাত ধরে উঠে এল ‘ব্র্যান্ড কলকাতা’। জয়ের পর সেই ‘ব্র্যান্ড’ আকাশে মাথা তুলল। ‘কহানি’র হাত ধরে বলিউড-বিজয়ের পরে এ বার কলকাতার নামটা সবার উপরে জ্বলজ্বল করল বিনোদনের এই রাজসূয় যজ্ঞে।
উৎসবে ‘কলকাত্তাইয়া’ চরিত্রটি ফুটবে কীসে? ডার্বিতে সাধারণত বঙ্গভঙ্গ হয়ে যায় চিংড়ি আর ইলিশের শিবির-বিভাজনে। আইপিএল-পার্বণী উদ্যাপিত হবে কী দিয়ে? “রুই বা কাতলা যেটা কলকাতায় সবথেকে বেশি পাওয়া যায়, সেটাই বাছা হবে। সবাইকে একই মাছ কিনতে হবে তো,” বলছিলেন ময়দানে লাল-হলুদের জন্য চিৎকার করা এক পরিচিত মুখ। “হ্যাঁ হ্যাঁ। রুই বা কাতলাই ভাল,” সমর্থন করলেন যিনি, তাঁকে গঙ্গাপারের ক্লাব মোহনবাগানে বসে থাকতে দেখা যায়।
আইপিএল-কে ঘিরে শহরভিত্তিক আবেগ আর আনুগত্যের যে একটা নবতরঙ্গ চোখে পড়ছে, সেটা অস্বীকার করছেন না সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীও। কিন্তু কলকাতার ক্ষেত্রে খেলাকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া আবেগ কি খেলা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে যায়নি? সামগ্রিক ভাবে শহরটারই একটা নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করে দেয়নি? আশিস বললেন, “এটা তখনই হয়, যখন শহরকে ঘিরে একটা আবেগ আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকে।” কী রকম? কলকাতা, মুম্বই, হায়দরাবাদ বা লখনউয়ের মতো শহরকে কেন্দ্র করে মানুষের একটা দীর্ঘ আবেগের ইতিহাস আছে। শহরের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। ‘‘চণ্ডীগড় নিয়ে এত আবেগ নেই কিন্তু। আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক নিয়ে যে আবেগ আছে, হিউস্টনকে নিয়ে নেই!”
কলকাতা নিয়ে আবেগ আর ইতিহাস, দুইই অঢেল। বিশ্বের প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাবগুলোর একটার নাম কিন্তু, ‘ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব’! পরে ফুটবল যোগ হওয়ার পর সেটাই সিসিএফসি নামে পরিচিত। ইতিহাস বলছে, ১৯৬২ সালে সিসিএফসি-তেই পাঁচ ম্যাচের একটা সিরিজ হয়েছিল। সেখানে প্রতিটা দল ২০ ওভার করে খেলেছিল! তার মানে, টি-টোয়েন্টির আঁতুড়ঘর এই কলকাতাই! কলকাতার টানেই রবিবার ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে বসেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য। বললেন, “আমি তো কলকাতার লোক। গম্ভীর না বালাজি কে খেলল, তাই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। কলকাতা খেলছে, এটাই বড় কথা।” দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ঘরের পাশে ও-পার বাংলা বা রাজধানী দিল্লি খেলোয়াড় যিনি যেখান থেকেই আসুন, কলকাতার কাছে সব্বাই এই ক’দিন ‘ঘরের ছেলে’। চিমা থেকে ব্যারেটো যেমন ছিলেন, ‘ক্লাবের ছেলে’!
ফুটবলেও এ বার আইপিএলের মতো একটা টুর্নামেন্ট করার প্রস্তাব ফেডারেশনের কাছে দিয়েছেন ভাইচুং। “শুনেছি ফেডারেশন নিজেই ভাবছে এমন কিছু করার। যদি হয়, তা হলে কলকাতা এফসি বা বাংলা এফসি তো হতেই পারে। শাহরুখ খান হয়তো ওই টিমটাও কিনে নেবে!”
|