নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কলকাতার জয়ের জন্য টিভি’র সামনে উন্মুখ হয়ে রয়েছেন চেন্নাইয়ের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর শিক্ষক সুরজিৎ পাল। পাশে বসে বছর পনেরোর মেয়ে ইপ্সিতা চেঁচাচ্ছে ধোনির সমর্থনে!
রবিবার চিপকে আইপিএল ফাইনালে যুযুধান দু’শহরের লড়াইয়ের আঁচ এ ভাবেই দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে প্রবাসী বিভিন্ন বাঙালি পরিবারকে। প্রবীণ প্রজন্ম কলকাতার জয় চাইলেও নবীনদের বাজি ধোনিবাহিনী! যেমন পাল-বাড়িতে। আঠারো বছর ধরে চেন্নাইয়ের রানাপুরমের বাসিন্দা সুরজিৎবাবু জানাচ্ছেন, “আমি আপ্রাণ কলকাতার সমর্থক। কিন্তু মেয়ে চেন্নাইয়ের দিকে।” গৃহিণী কোন পক্ষে?
সেটা অবশ্য গোড়ায় বাবা-মেয়ে কারও কাছে পরিষ্কার ছিল না। “উনি মোটামুটি দু’দিকেই তাল দিয়ে চলছেন।” মন্তব্য করেছিলেন সুরজিৎবাবু। তবে খেলা যত গড়িয়েছে, গৃহকর্ত্রী রিঙ্কুর সমর্থন তত ঝুঁকেছে সুপার কিংসের দিকে।
ওঁদের মতো এ দিন দু’শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল কুণ্ডু-বাড়িও। চেন্নাইয়ের খড়্গপুরের পরিবারটির গৃহকর্তা প্রদীপ কুণ্ডু বেসরকারি সংস্থার চাকুরে। নাইটরা প্রথম ফাইনালে ওঠায় তিনি যথেষ্ট উত্তেজিতও। আগে কখনও কেকেআরের হয়ে এমন উৎসাহ দেখাননি। তাঁর কথায়, “এই প্রথম কলকাতা ফাইনালে উঠল। জিতলে খুব ভাল লাগবে।” অথচ বাড়িতেই হাজির তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ ছেলে প্রত্যুষ! নবম শ্রেণির ছাত্রটি এ দিন সুপার কিংসের হয়ে আগাগোড়া গলা ফাটিয়ে গিয়েছে। |
খেলার মাঠে নবীনারা। রবিবার চেন্নাইয়ে উৎপল সরকারের তোলা ছবি। |
আসলে প্রবাসে নিজের শহরের খেতাব দখলের লড়াইটা বাঙালির প্রবীণ প্রজন্মের আবেগ উস্কে দিয়েছে। তা হলে তাঁদের সন্তানদের কাছ থেকে সেই ‘সমর্থন’ কেন পাচ্ছে না কলকাতা? উত্তর দিল সুরজিৎবাবুর মেয়ে ইপ্সিতা “ছোট থেকে এ শহরে বেড়ে উঠেছি। এটাই এখন নিজের শহর। তাই আমরা ধোনির হাতে কাপ দেখতে চাই।” কিশোরী ইপ্সিতার মতো প্রবাসে বড় হয়ে ওঠা নবীন বাঙালিদের অধিকাংশের কাছে চিপকই এখন ‘ঘরের মাঠ।’
প্রবাসে বড় হয়ে ওঠা নবীন প্রজন্মের কাছে চেন্নাই ঘরের মাঠ হতে পারে। কিন্তু যে ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা বা চাকরির তাগিদে দক্ষিণী রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন, তাঁরা অনেকে চেঁচিয়েছেন ‘টিম গম্ভীর’-এর সমর্থনেই। কেউ ফ্ল্যাটে দল বেঁধে বসেছেন টিভি’র সামনে। কেউ হস্টেলের ঘরে বসে টিভি’র অভাব মিটিয়েছেন অনলাইনে খেলা দেখে। যেমন চেন্নাই আইআইটি’র ছাত্র-গবেষক সোমরাজ গুহ ও তাঁর বন্ধুরা এ দিন নেটেই খেলা দেখেছেন। আর ইনিংস যত গড়িয়েছে, পাল্লা দিয়ে চিৎকারও বেড়েছে তাঁদের। সোমরাজের কথায়, “কাজের খাতিরে এ রাজ্যে রয়েছি। তা বলে চেন্নাইকে সাপোর্ট করব কেন? মন পড়ে রয়েছে কলকাতাতেই।”
চেন্নাই-প্রবাসী আইটি-কর্মী ত্রিদিব দাসেরও এ দিন মাঠে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। টিকিট পাননি। অগত্যা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে টিভি’র সামনে জড়ো হয়েছিলেন। ফোনে বললেন, টিকিট না-পাওয়াটা শাপে বর হয়েছে। কেন? ত্রিদিবের যুক্তি, “আমার অফিসের কয়েক জন সহকর্মী মাঠে যাচ্ছে। ওরা সকলে চেন্নাইয়ের সমর্থক। চেন্নাই হারলে ওদের সামনে আনন্দ করাটা ভাল দেখাবে না। তাই এক হিসেবে ভালই হয়েছে।”
উল্লাসে আগল না-থাকায় ত্রিদিবেরা অতএব নিশ্চিন্ত। খেলার দ্বিতীয় ওভারে ব্রেট লি’র বলে মাইকেল হাসি চার মারতেই ফোনের ও-পাশ থেকে ভেসে এল তাঁদের পাল্টা গর্জন, “করছি, লড়ছি, জিতছি রে।” গম্ভীরের হাতে কাপ উঠলে কী ভাবে জয় উদ্যাপন করবেন, তারও মোটামুটি পরিকল্পনা সন্ধেতেই ছকে ফেলেছিলেন ওঁরা। আবার রাতে তামাম দেশ যখন টিভি’র সামনে হামলে পড়েছে, আদ্যন্ত ক্রিকেটভক্ত শান্তনু দাস তখন জরুরি বৈঠকে ব্যস্ত। মগ্যাপার ইস্টের বাসিন্দা, বিশ বছরের চেন্নাইবাসী ওই কলকাতাপ্রেমী বৈঠক থেকেই ফোনে জানালেন, “খেলা দেখলে তো কলকাতাকেই সমর্থন করতাম!”
শান্তনুবাবুর ছেলে উন্মেষ অবশ্য টিভি-তে খেলা দেখছেন নিছক আনন্দের জন্য। “কাউকে সাপোর্ট করছি না। স্রেফ খেলার মজাটা নিচ্ছি।” বলছেন ইঞ্জিনিয়ারিং-পড়ুয়াটি। একই ভাবে চেন্নাই বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তাও জানালেন, তিনি কাউকে সমর্থনের মধ্যে নেই। ওঁর সাফ কথা, “খেলাটা হচ্ছে শ্রীনিবাসনের দলের সঙ্গে শাহরুখের দলের। তাতে আমাদের কার কী এসে গেল?” |