মান্টিদের বেড়াল দুটো বারান্দায় গা এলিয়ে লেজ নাড়ছিল। একটার গা শুধু সাদা তুলো দিয়ে ঢাকা। আর একটার গায়ে কালো ছিটে ছিটে দাগ। সাদা বেড়ালটার নাম টুসটুস। আর কালো ছিটেটার নাম রেখেছে টিকি। শীতের দুপুরে রোদ্দুরে শরীরটা গরম করে নিচ্ছিল ওরা। এর পর বারান্দাতে লম্ফঝম্প করবে, বিকেল পর্যন্ত চলবে। সন্ধের পর ওরা চুপচাপ। দুটো বাটিতে দুধ রাখা আছে। সেখানে গিয়ে মুখ ডুবিয়ে চেটেপুটে খাবে। খাওয়া শেষে সোজা খাটটার নীচে। আজ মান্টি স্কুলে যায়নি। সামনে ফার্স্ট টার্ম একজাম। বাড়িতে পড়ে নিচ্ছিল। বিকেলে আন্টি আসবেন। তার আগে পড়াগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছিল মান্টি। ঝালিয়ে নিতে নিতেই বারান্দার দিকে তাকাচ্ছিল। বেড়াল ছানা দুটো বারান্দায় এতক্ষণ রোদে পিঠ পেতেছিল। এই বার শরীরটা উল্টে দিল টুসটুস। উল্টে আবার গড়াগড়ি খেতে লাগল। টুসটুসের দেখাদেখি টিকিও এক পাক ঘুরে গিয়ে উল্টে গেল।
মান্টি এ ঘর থেকে ঠিক বেড়ালের মতো ডাক দিল ম্যা-ও-ও। আর তক্ষুনি ছানা দুটো ঘরে গিয়ে ছিটকে গেল ও ধারে। তার পর লেজ তুলে দৌড়।
চেয়ারে বসে বই সামনে রেখে দুই বেড়ালছানার কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে মান্টি। জোরে হাসলেই পাশের ঘর থেকে মা তক্ষুনি চেঁচিয়ে বলে উঠবে, পড়া ছেড়ে কী হচ্ছে রে মান্টি?
তার মা একটু একটু রাগী। অন্য সময় তেমন বকাঝকা করেন না। কিন্তু পড়ার সময় ফাঁকি দিলেই রেগে আগুন হয়ে যান।
এই তো ক’দিন আগে বারান্দার সামনে ঘোরাঘুরি করছিল বেড়ালছানা দুটো। ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছিল আর মিউমিউ করে ডাকছিল। স্কুল থেকে ফিরে ওদের দেখে বড্ড খারাপ লাগছিল। পশুপাখিদের ওপর মান্টির ভীষণ মায়া। রোজ সকালে বাড়ির সামনে ভিড় জমায় ক’টা কাক। ও ওদের সামনে রুটির টুকরো ছুড়ে দেয়। দু’একটা কাকা ক্যাচ লোফার মতো রুটির টুকরো লুফে নেয়। বাকিরা পারে না। তারা মাটি থেকে ঠোঁট দিয়ে তুলে নেয়। এর মধ্যে একটা এক পা-ওলা কাকও আছে। সে বেচারা বাকিদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না। মান্টির দিকে দুঃখ দুঃখ মুখ করে তাকিয়ে থাকে। বাকিরা উড়ে গেলেও সে বেচারি চুপটি করে বসে থাকে। মান্টি তাকে রুটি, বিস্কুটের টুকরো ছুড়ে দেয়। ওর কাক-প্রীতি নিয়ে বাবা-মা কিছু বলে না। সে দিন স্কুল থেকে ফিরে গ্রিলের দরজা খুলতেই বেড়ালছানা দুটো লাফিয়ে ঢুকে পড়ল। মা ভুরু কুঁচকে ছিলেন। মান্টি নিচু হয়ে বারান্দার কোণে গুটিশুটি মেরে থাকা তাদের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলে উঠেছিল, ইস! কী সুন্দর দেখতে। মা, ওরা থাক না। প্লিজ মা। |
মায়ের মুখটা তখনও তিতকুটে। পাঁচিলের ওপর তখন কতগুলো ধাড়ি কাক গর-গর ঘর-ঘর করে ডাকছিল। কেউ চোখ পাকিয়ে, কেউ পাঁচিলে ঠোঁট ঠুকছে। দু’একটা আবার বারান্দার দিকে উড়ে আসছিল। আর বারান্দার কোণে চুপটি করে গুটিশুটি পাকিয়ে বসে ওরা ম্যা-ও-ও করে ডাকছিল।
তার পর থেকে বারান্দার কোণেই থেকেই গেল ওরা। মাঝে মাঝে মুখ তুলে ডাকে মিউমিউ করে। মান্টি স্কুল যাওয়ার সময় ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে যায়। মা দেখতে পেলেই বলেন, অ্যাই, স্কুলে গিয়ে হাতটা ধুয়ে নিস।
আচ্ছা, ধবধবে তুলো মতো ওদের গায়ে কি কোনও নোংরা লেগে থাকে? ওদের দেখলেই তো আদর করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে হয় কোলে নিয়ে চকাস চকাস করে চুমু খাই। বুকে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিতে ভীষণ ইচ্ছে হয়।
আজ দুপুরেই কাণ্ডটা ঘটল। মান্টি চেয়ারে বসে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে, খাতায় লিখছে। আর মাঝে মাঝে বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে। একটু আগে মান্টির ম্যা-ও ডাকে টুসটুস আর টিকি লেজ তুলে চোঁচা দৌড় মেরেছিল। আবার ওরা গুটি গুটি পায়ে ফিরে এসেছে। তার পর বারান্দার কোণে গোল্লা পাকিয়ে রইল। তক্ষুনি আবার একটা চড়ুই এসে গ্রিলে বসে ডাক দিল চিড়িক চি-ড়ি-ক। বাচ্চা দুটো চোখের পাতা পিটপিট করে তাকাল। চড়াই দু’চার বার চি-ড়ি-ক ডেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল ওই দিকে। তার পর চার দিক সুনসান নিস্তব্ধ। কোত্থাও কোনও শব্দ নেই। পড়তে পড়তে দু’চোখ তার ঘুমে ঢুলু হয়ে আসছে। অমনি হঠাৎ ম্যা-ও শব্দ। বেশ জোরে। আর তক্ষুনি চেয়ার ছেড়ে ও সটান চলে গেল দরজার কাছে। কী সাংঘাতিক কাণ্ড! গ্রিলের ওপারে কুচকুচে কালো একটা ইয়া বড় বেড়াল বসে মুখ নাড়ছে। ইয়া লম্বা লম্বা কান। হলুদ-সাদা মার্বেলগুলির মতো গোল্লা দুটো চোখ। দাঁত-মুখ খিঁচোতেই সাদা ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল।
আর তাকে দেখে টুসটুস একটা পাক খেয়ে ‘ফ্যাঁচ’ করে উঠল। তার পর টিকিও ছোট্ট গোঁফ জোড়া নাচিয়ে টুসটুসের মতো ফ্যাঁ-চ করে তেড়ে গেল। মান্টি চমকে গিয়ে দেখল, কালো বেড়ালটা গ্রিল ছেড়ে লাফ দিচ্ছে। কোথাও কিচ্ছু নেই, পাঁচিলের ওপার থেকে পাড়ার নেড়িটা ঘে-উ-উ করে ডেকে উঠল। আর যায় কোথা, কালো ধুমসো বেড়ালটা লেজ তুলে ও পাশের রাস্তায় দে দৌড়। একেবারে পগারপার। যেন বড় একটা কাজ করা গেছে, এমন ভাব করে টুসটুস আর টিকি বারান্দায় পাক খাচ্ছে তো খাচ্ছেই।
মান্টি ছুটে এসে ওদের দুটোকে কোলে তুলে নিল। |