|
|
|
|
চিরতৃষ্ণায় না-মৃত সেই কাউন্ট |
১১৫ বছর আগে ঠিক এই দিনটিতে প্রকাশিত হয়েছিল ব্রাম স্টোকার-এর ‘ড্রাকুলা’।
সেই রক্তসন্ধানী রাত্রিচরের আকর্ষণ আজও দুর্মর। চিরদীপ উপাধ্যায় |
আপাদমস্তক
কালো পোশাকে আবৃত তার দীর্ঘ, নির্মেদ শরীর। লম্বা মুখমণ্ডল; চওড়া, উঁচু কপাল; দুই কানের ওপর দিকটা অদ্ভুত সরু; নাসিকাটি তীক্ষ্ন, বঙ্কিম, দেখলে বাজপাখির ঠোঁটের কথা মনে পড়ে; মসৃণ করে কামানো গাল, লম্বা গোঁফ সম্পূর্ণ সাদা; প্রশস্ত এবং কঠিন চিবুক; গোটা মুখের রং কেমন ফ্যাকাশে, যেন রক্তের অভাব, কেবল চোখ দু’টো লালচে, ওষ্ঠাধর অস্বাভাবিক রক্তিম, আর পরিপাটি সাজানো দাঁতগুলো কী আশ্চর্য সাদা, ঠোঁটের ওপর অল্প বেরিয়ে থাকা সেই দাঁতের সারি দেখলে গা শিরশির করে।
কাউন্ট ড্রাকুলা। পূর্ব ইউরোপের কার্পেথিয়ান পর্বতমালার এক অতি নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় তার দুর্গ। দিনের বেলায় তাকে দেখা যায় না। অন্ধকার তার বড় প্রিয়, মধ্যরাত্রে যখন নেকড়ের ডাক ভেসে আসে, দূর থেকে দেখা যায় তাদের জোড়া জোড়া আগুন-চোখ, তখন সে গাঢ় স্বরে বলে, ‘নিশার সন্তান ওরা, কী অপূর্ব ওদের সঙ্গীত!’
কাউন্ট ড্রাকুলা জীবিত নয়, কিন্তু মৃতও নয়, সে মৃত্যুহীন, না-মৃত ‘আনডেড’। মানবশরীরের তাজা রক্তই এই মৃত্যুহীনের না-মৃত থাকার উপকরণ। দিবাভাগে তার দেহ শায়িত থাকে নিজস্ব আশ্রয়ে, রাত্রে জেগে উঠে শিকারের সন্ধানে নিষ্ক্রান্ত হয়। কোনও মানুষের ওপর সরাসরি বলপ্রয়োগ করতে পারবে না, ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে’ প্রাণরস সংগ্রহের ক্ষমতা নেই তার। তাই সে রাত্রির অন্ধকারে আবেশ তৈরি করে। তার শিকার অজানা ভয়ে এবং অজানা মোহে আবিষ্ট হয়ে দেখে, একটা মুখ তার মুখের ওপরে নেমে আসছে... ঠোঁট দুটো এগিয়ে আসছে তার গলার দিকে... চিনচিনে ব্যথা... ভাল-লাগাও... আচ্ছন্নতা গভীর থেকে গভীরতর হয়... এমনি চলে দিনের পর দিন। |
|
ক্রমে সে রক্তশূন্য হতে থাকে, তার আচরণে নানা দুর্লক্ষণ দেখা যায়, রাতবিরেতে বেরিয়ে পড়তে চায়, হঠাৎ এক রাত্রে আবিষ্কার হয়, সে জানলা খুলে মাথাটা বাইরে এলিয়ে দিয়েছে, কাছে গেলে দেখা যায় সে একটা ঘোরের মধ্যে, গলায় দুটি রক্তবিন্দু, বাইরে মরা চাঁদের আলোয় একটা বাদুড় দূর থেকে আরও দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার পর এক দিন মানুষটি মারা যায়, এবং রক্তের সন্ধানে নির্গত হয়। সে-ও এখন মৃত্যুহীন, না-মৃত।
তো, এক দিন কাউন্ট ড্রাকুলা ‘দিমেতের’ নামক এক রুশ জাহাজে চড়ে লন্ডনের উদ্দেশে পাড়ি দিল। লন্ডন, কারণ সে মহানগরে অগণিত মানুষ, তাদের শিরা ও ধমনীতে অফুরন্ত তাজা, লাল রুধিরের স্রোত। ‘দিমেতের’ এক দিন ইংল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছল সম্পূর্ণ জনশূন্য, প্রাণহীন ক্যাপ্টেনের দেহটি ছাড়া; মিশকালো একটি কুকুর নীরবে জাহাজ থেকে নেমে মহানগরে মিশে গেল। অতঃপর একে একে আক্রান্ত হতে থাকে শহরের মানুষ। প্রথমে এক তরুণী। তিনি গলায় দুটি কাঁটার দাগ নিয়ে অচিরে মারা যান। তার পরেই সেই অঞ্চলে একের পর এক শিশু হারিয়ে যায়। বন্ধুরা বলে, ‘ব্লুফার লেডি’ ওকে নিয়ে গেছে। ‘ব্লুফার’ মানে বিউটিফুল।
কী হবে এ বার? না-মৃত পিশাচ এবং তার অনুগামীদের গ্রাস থেকে কে বাঁচাবে মানুষের সভ্যতাকে? পাঁচ পুরুষ আর এক নারী সেই দায়িত্ব নেন। একে একে নির্মূল করেন অন্য ভ্যাম্পায়ারদের। তার পর, এক আশিরনখ রোমাঞ্চকর অভিযানের শেষে এক গোধূলিলগ্নে স্বভূমিতেই ধ্বংস হয় কাউন্ট ড্রাকুলা, তার দেহ আক্ষরিক অর্থেই ধূলিসাৎ হয়। অনেক শতাব্দীর অভিশাপের অবসান হয়। সন্ধ্যার রক্তিম না, থাক, লাল আকাশে জেগে থাকে পাহাড়চূড়ার নির্জন দুর্গ। |
২৬ মে, ১৮৯৭ |
লন্ডন শহরে প্রকাশিত হল ব্রাম স্টোকার-এর ‘ড্রাকুলা’। সমালোচকরা শুরু থেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও বইয়ের কাটতি বেড়েছে ধীরে ধীরে। তবে দুনিয়া জুড়ে ড্রাকুলার জনপ্রিয়তা বিস্তারে আসল কৃতিত্ব যে বস্তুটির, তার নাম সিনেমা। ১৯৩১ থেকেই চলচ্চিত্রের পর্দায় ড্রাকুলার দিগ্বিজয় শুরু, এ পর্যন্ত দুশোর বেশি ছবিতে এই না-মৃত পুরুষটিকে দেখা গিয়েছে, এক জনই নাকি তাঁর থেকে (সামান্য) এগিয়ে শার্লক হোমস।
কী ছিল, কী আছে এই সাফল্যের পিছনে? অজানার প্রতি, রহস্যময়তার প্রতি, ভয়ঙ্করের প্রতি আমাদের স্থানজয়ী, কালজয়ী, পাত্রজয়ী আকর্ষণ? আলবাত, কিন্তু শুধু সেটুকু বলে থেমে গেলে কাউন্ট ড্রাকুলা এবং তার স্রষ্টার প্রতি অবিচার হবে। আরও কয়েকটা কথা খেয়াল করে নেওয়া দরকার। |
অজানা আতঙ্ক |
উনিশ শতকের শেষ দুই দশক ব্রিটেনের পক্ষে খুব তাৎপর্যপূর্ণ সময়। রানির সাম্রাজ্য তখন মধ্যগগনে। আর ক্ষমতার নীচেই তো ক্ষমতা হারানোর ভয়। সূর্যাস্তহীন সেই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর যে জাতি, তার অবচেতনে কেবলই দুঃস্বপ্ন এই বুঝি অচেনা, অজানা কোনও শত্রু আক্রমণ করে, এমন শত্রু যাকে মোকাবিলার উপায় জানা নেই। ইংল্যান্ডে এমন কল্পিত আক্রমণের নানা কাহিনির বান ডেকেছিল সে আমলে, মানুষ গোগ্রাসে গিলেছিল সে সব গল্প। সুদূর, রহস্যময়, কার্পেথিয়ান পর্বতমালার অজ্ঞাতলোক থেকে আবির্ভূত ড্রাকুলার সর্বগ্রাসী নৈশ অভিযানের রক্ত-জল-করা কাহিনি তো এই সমাজে জনপ্রিয় হবেই! |
বিজ্ঞান বনাম প্রাচ্য |
ড্রাকুলার ইংল্যান্ড অভিযান এক অর্থে আধুনিকতার বিরুদ্ধে প্রাচীনতার জেহাদ। সে দিনের শিল্পবিপ্লব-উত্তর পশ্চিম ইউরোপ তার নবলব্ধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গর্বে গর্বিত, সে বিশ্বাস করে, যুক্তি আর বিজ্ঞান দিয়েই সব শত্রুকে পর্যুদস্ত করা যায়। এই আত্মবিশ্বাসী পশ্চিমের কূলে এসে লাগে পূর্ব ইউরোপের ইউরোপের নিজস্ব প্রাচ্যের অলৌকিক জলযান। জাহাজ থেকে নিঃশব্দে লাফিয়ে কূলে নামে রহস্যময় কৃষ্ণাঙ্গ সারমেয়। আধুনিক পশ্চিম কোন অস্ত্রে তার মোকাবিলা করবে?
উত্তর জানেন এব্রাহাম ভ্যান হেলসিং। অ্যামস্টাডার্ম-এর এই পণ্ডিত পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে শিক্ষিত, আবার প্রাচ্য বিদ্যা এবং বিশ্বাসের ভুবনও তাঁর আয়ত্ত। যে ছ’জন সাহসী মানুষ কাউন্ট ড্রাকুলার মোকাবিলায় নামেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র ভ্যান হেলসিং জানেন মৃত্যুহীন ভ্যাম্পায়ারদের রক্তসন্ধানের রহস্য। জানেন এবং মানেন। তাঁর কাছে সব বিদ্যাই জরুরি। ‘অবিদ্যা’ও। তাঁর বক্তব্য, ‘আমাদের বিজ্ঞানের দোষ হল, কোনও জিনিসের ব্যাখ্যা দিতে না পারলে সে বলে, ব্যাখ্যা করার কিছু নেই।’ ক্রুশ সহ নানা খ্রিস্টীয় উপকরণ ব্যবহার করেন তিনি সেই সংগ্রামে, তাই লম্বা মুখ, সূচ্যগ্র কান, জ্বলন্ত চোখ, শ্বদন্ত, কালো পোশাক খ্রিস্টীয় ধারণায় মার্কামারা ‘ডেভিল’-এর ছাঁচে ঢালা ‘শয়তান’ ড্রাকুলার সঙ্গে গোটা লড়াইটাই খ্রিস্টধর্মের অশুভবিনাশী শক্তির কাহিনি হিসেবেও দিব্যি পড়া (বা দেখা) যায়। গল্পের শেষে অভিশপ্ত আত্মাগুলি যে ভাবে মুক্তি পায়, সেটাও ‘স্যালভেশন’-এর গল্প।
এ কাহিনির জনপ্রিয়তা তো কোনও বিশেষ ধর্মের সীমায় সীমিত থাকার নয়। মানুষ ‘ধর্মের জয়’ দেখেভরসা পায়। অনন্ত, অবিরত, অনিশ্চয়তার মাঝদরিয়ায় ওটাই তার মোচার খোলা। আসলে নিজেকে নিয়ে আধুনিক পৃথিবীর সংশয়ের শেষ নেই, সে সারাক্ষণই এই আশঙ্কায় থাকে যে, অনাধুনিক পৃথিবীর অজ্ঞাত বিপদ এসে এই বুঝি তাকে পেড়ে ফেলল। তাই আজও ভৌতিক, রহস্যময়, অতীন্দ্রিয় কাহিনির এমন মৃত্যুহীন জনপ্রিয়তা। আমরা কোনও কিছুকেই অবিশ্বাস করতে ভয় পাই। আসলে আমরা অবিশ্বাসকেই ভয় পাই। |
ডাকিনী যোগিনী |
ড্রাকুলা বৃত্তান্তের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অন্তিম উনিশ শতকের ইংরেজ সমাজের আর এক ভয়। সে ভয় নারীর যৌনতা নিয়ে, তার কামনা নিয়ে। ভিক্টোরীয় সমাজ সে যৌনতাকে অস্বীকার করেছিল, সে কামনাকে ছলে বলে কৌশলে দমন করতে চেষ্টার অন্ত রাখেনি, নৈতিকতার বিধান দিয়ে মেয়েদের বেঁধে ফেলার সেই প্রকল্প ঔপনিবেশিক পরম্পরায় আমাদেরও কম প্রভাবিত করেনি, আজও তার বহু উত্তরাধিকার আমরা বহন করে চলেছি।
ড্রাকুলা এই নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে। ইংল্যান্ডের মৃগয়াভূমিতে কাউন্ট ড্রাকুলার প্রথম এবং প্রধান শিকার ছিল লুসি ওয়েস্টার্না, ‘নিষ্পাপ পবিত্রতা’য় যে তরুণী ভিক্টোরীয় নারীর প্রতিমূর্তি। ক্রমশ সেই মেয়ে ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়, ‘ব্লুফার লেডি’ হয়ে নিষ্পাপ শিশুদের রক্তপান করে। এক সময় কাউন্ট ড্রাকুলা ভ্যান হেলসিংকে তীব্র ব্যঙ্গের সুরে বলে, ‘তোমাদের মেয়েরা এখন আমার হয়ে গেছে, আর ওদের মারফত তোমরাও আমার দখলে চলে আসবে।’ এ যেন ইভকে সামনে রেখে আদমকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে শয়তান!
আসলে এই কাহিনিতে লুকিয়ে আছে পুরুষের আদি আতঙ্ক ঘরের মেয়েকে বাইরের আকর্ষণের কাছে হারিয়ে ফেলার ভয়। লক্ষণীয়, ড্রাকুলা তার শিকার মেয়েটিকে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, সেই মেয়ে তার দুই তীক্ষ্ন দাঁতের কাছে নিজের গলা এগিয়ে দেয়, এবং ক্রমশ নিজেও তার রক্তের তৃষ্ণায় সংক্রামিত হয়ে ওঠে, চির-অতৃপ্ত কামনা নিয়ে শিকার খোঁজে। তখন তাকে ধ্বংস না করে সমাজের চোখে ঘুম নেই, কারণ যে মেয়ের নিজস্ব কামনা আছে, যে মেয়ে সেই কামনাকে প্রকাশ করে, পুরুষকে তার ‘ছলাকলায়’ ভুলিয়ে এক সময় তার কণ্ঠের কাছে মুখ নামিয়ে আনে, তাকে মেনে নিলে সমাজ টিকবে কী করে? ভ্যাম্পায়ার থেকে ভ্যাম্প ডাকিনী-যোগিনীর ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত সমাজের চিরশত্রু, কারণ তারা লক্ষ্মণের গণ্ডি ডিঙিয়ে বেরিয়ে গেছে, কখনও বাঁশির ডাকে, কখনও বাদুড়ের হাতছানিতে। কাউন্ট ড্রাকুলা তো ‘আনডেড’ হবেনই।
|
• ১৯৩১-এ তৈরি হয় প্রথম অফিশিয়াল ড্রাকুলা ফিল্ম ড্রাকুলা। পরিচালক
পল লেনি ও মূল চরিত্র লন চেনি, ছবি শুরুর আগেই মারা যান। নতুন দল নিয়ে এর পর শুরু হয় ছবি। নামভূমিকায় বেলা লুগোসি আইকন হয়ে যান।
•
১৯২২-এ ড্রাকুলাকে নিয়ে একটি ফিল্ম তৈরি হয়, নসফেরাতু। গল্প এক
হলেও, ড্রাকুলা নাম বদলে এখানে
কাউন্ট ওরলক।
• ১৯৭০-এ ক্রিস্টোফার লি অভিনীত কাউন্ট ড্রাকুলা-য় প্রথম দেখি,
ড্রাকুলা প্রয়োজন মতো বয়স কমিয়ে
নিচ্ছে। ছবির শুরুতে সে বৃদ্ধ,
ক্রমশ
ঝাঁ-চকচকে মধ্যবয়সী।
• ১৯৯২-এ পরিচালক ফ্র্যান্সিস ফোর্ড কপোলা তৈরি করেন ড্রাকুলা। ছবির শেষে ছিল অ্যানি লেনক্স-এর একটি গান: ‘লাভ সং ফর আ ভ্যাম্পায়ার’। |
|
|
|
|
|
|