প্রশাসনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’ (বিনা কাজে বসিয়ে রাখা) ব্যাপারটা এ যাবৎ আইএএস-আইপিএস-ডব্লিউবিসিএস’দের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ বার এক সঙ্গে চার সরকারি ডাক্তারের বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ করে নজির গড়ল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।
এবং এর পিছনে আসল কারণটা ঠিক কী, তা-ও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। দফতরের দাবি, ‘প্রশাসনিক গাফিলতির শাস্তি’ হিসেবেই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের চার চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা। কিন্তু ‘গাফিলতি’টি কী ধরনের, স্বাস্থ্য-কর্তারা তা ভাঙেননি। যদিও শাসকদল তৃণমূলের এক বিধায়কের দাবি: ওঁদের বিরুদ্ধে র্যাগিংয়ে পরোক্ষ মদতদানের ‘গুরুতর’ অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছাতেই এই সিদ্ধান্ত।
চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এত দিন সাসপেনশন, পদোন্নতি রদ, বদলি, বা বরখাস্তেই সীমাবদ্ধ ছিল। যাঁদের বেলায় সরকার ‘প্রথা’ ভাঙল, তাঁরা হলেন বর্ধমান মেডিক্যালের ফিজিওলজি’র বিভাগীয় প্রধান সরিৎ চৌধুরী, শল্যচিকিৎসক প্রাণগোপাল সরকার, প্যাথলজি’র তপনকুমার ঘোষ ও কমিউনিটি মেডিসিনের আদিত্যপ্রসাদ সরকার। আর যে ছাত্রের ‘অভিযোগের’ ভিত্তিতে তাঁদের এই শাস্তি, বর্ধমান মেডিকালের ছাত্র সেই প্রসেনজিৎ পর্বত নির্দিষ্ট ভাবে ওঁদের নামে লিখিত নালিশ জাননানি। তাঁর বক্তব্য, কলেজে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছেন, যাতে ‘কিছু’ চিকিৎসকের পরোক্ষ মদত আছে। এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেননি। তবে জানিয়েছেন, বর্ধমানের পুলিশ সুপার ও জেলাশাসককে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। কী লিখেছিলেন?
উলুবেড়িয়ার কাঁটাবেড়িয়ার বাসিন্দা প্রসেনজিৎ বলেন, “চার চিকিৎসকের নাম লিখিনি। শুধু পদবি লিখেছিলাম। আর মুখ্যমন্ত্রীকে প্রণাম করে মৌখিক ভাবে সব জানিয়ে জ্বালা জুড়িয়েছি।” তিনি চিঠিতে চিকিৎসকদের ‘হার্মাদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বলে অভিযোগ উঠলেও প্রসেনজিৎ তা মানতে নারাজ। উলুবেড়িয়ার তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাজির (যিনি নিজেও চিকিৎসক) দাবি, তিনিই ওকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যান। বিধায়কের কথায়, “চার শিক্ষকের নামে এমন অভিযোগ শুনে আমি মুখ্যমন্ত্রীকে সব বলি। উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। তাঁর নির্দেশেই স্বাস্থ্য-সচিব থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সকলকে জানাই। অধ্যক্ষ-ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলি। নির্দেশ জারি হয়।”
বিশেষ স্বাস্থ্য-সচিব মনোজ চৌধুরী গত ১৫ মে চার ডাক্তারকে চিঠি পাঠিয়ে ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ স্বাস্থ্যভবনে যোগ দিতে বলেছেন। নির্দিষ্ট ভাবে লিখিত অভিযোগ ছাড়াই এ হেন নজিরবিহীন ব্যবস্থা কেন?
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “আগে হয়নি বলে কখনও হবে না, এমন তো নয়! ওঁদের নামে বেশ কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে। তাই আপাতত এই ব্যবস্থা।” স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও বলেন, “কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে।” তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘প্রগ্রেসিভ সার্ভিস ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক দেবাশিস বিশ্বাসের ব্যাখ্যা, “দুর্নীতিতে মদত, দুর্নীতিগ্রস্তদের আড়ালের চেষ্টা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায়েই এই সিদ্ধান্ত।”
তবে উল্টো সুরও আছে। যেমন বর্ধমান মেডিক্যালের তৃণমূল ছাত্র পরিষদেরই সাধারণ সম্পাদক রানা মজুমদারের মন্তব্য, “এখানে র্যাগিং হয় না বললেই চলে। আর শিক্ষকেরা খামোকা র্যাগিংয়ে মদত দেবেনই বা কেন?” উল্লেখ্য, বর্ধমান মেডিক্যালের ছাত্র ইউনিয়ন এখন তৃণমূলেরই দখলে। কলেজ-সূত্রের খবর: চার ডাক্তারের মধ্যে শুধু এক জনই সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাকিদের এক জন জীবনযাপনে বামপন্থী হলেও সরাসরি রাজনীতি করেননি। তৃতীয় জনেরও রাজনৈতিক সংশ্রব নেই। চতুর্থ জন কট্টর কংগ্রেসি পরিবারের ছেলে। বামপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেল্থ সার্ভিস ডক্টরস’ কলেজে পোস্টার দিয়ে পাল্টা অভিযোগ তুলেছে, “রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির মতলবেই ওঁদের নাম জড়ানো হচ্ছে।”
প্রসেনজিৎ ২০০৫-এ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ২০০৭-এ জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিন বছর প্রথম বর্ষে থেকে এখন তৃতীয় বর্ষে। ছাত্রদের একাংশ জানিয়েছেন, পরীক্ষায় একাধিক বার অকৃতকার্য তরুণটি আগেও ক’বার র্যাগিংয়ের মৌখিক অভিযোগ করেছেন। এ বার এতটা এগোলেন? প্রসেনজিতের জবাব, “ইদানীং অত্যাচার সীমা ছাড়িয়েছিল। খুনের হুমকি দিচ্ছিল।”
শাস্তিপ্রাপ্ত ডাক্তারেরা কী বলেন?
তাঁদের তরফে তপনবাবুর বক্তব্য, “এখনও জানি না, অভিযোগটা ঠিক কী! কারও কিছু বলার থাকলে স্বাধীন দেশে তিনি বলতেই পারেন। আমরা ছাপোষা ডাক্তার। ঝামেলা চাই না। দফতর যা বলবে, মাথা পেতে নেব।”
|