অন্নপ্রাশনের উপহার দেওয়া থালা-বাটি ও গ্লাসের গায়ে লেখা থাকত খুকুমণি বা খোকাবাবু। নামের চারদিকে লতাপাতার সুদৃশ্য বন্ধন। সচ্ছ্বল পরিবারে মেয়ের বিয়েতে ‘ষোলো দান’। প্রথম সংসার পাতার শুরুতে ঘরণীর জন্য সুন্দর উপহার। বাসন-কোসন থালা-বাটি ছাড়াও গৃহদেবতার পুজোর জন্যে পিলসুজ থেকে জল-ঘটি কত কী। শুধু হিন্দু (বিশেষ করে বাঙালি) পরিবারেই নয়, পিতলের এমন সব জিনিসের ব্যবহার ছিল মুসলমান পরিবারেও।
আধুনিক নানা বিকল্পের সম্ভারে এ সব এখন অনেকটাই স্মৃতি। তবু যেটুকু রয়েছে, তার পথ ধরেই কাঁসা-পিতলের শিল্পে বিখ্যাত নবদ্বীপে এখনও চল্লিশ-পঞ্চাশ ঘরের মতো কারিগর টিকে রয়েছেন। আর এই গুটিকয় কারিগরের মধ্যেই রয়েছেন নয় পুরুষ ধরে কাজ করে চলা কাঁসা-পিতলের শিল্পী লালমোহন মণ্ডল। অবিভক্ত বাংলায় এই শিল্পে যে পরিবারের খ্যাতি ছড়িয়েছিল। “এক সময় খাগড়া (মুর্শিদাবাদ) খড়ার (মেদিনীপুর), হুগলির বালি-
|
লালমোহন মণ্ডল। |
দেওয়ানগঞ্জও বেশ নাম করেছিল। তবে প্রত্যেক স্থানের বিশেষ বিশেষ পাত্র ছিল বিখ্যাত। কিন্তু নবদ্বীপ ছিল অগ্রণী। সংসারের ব্যবহার্য এবং পুজোর সামগ্রীতে। বাবা তেঁতুলচন্দ্র ও দাদু হাবলচন্দ্রের মুখে শুনেছি, আমাদের আদি দেশ ছিল কোচবিহারে। প্রায় দুশো বছর আগে আমাদের প্রথম পুরুষ বলরাম রাজবংশী চলে আসেন নবদ্বীপে। দাদুর আমল থেকে আমাদের পদবী মণ্ডল। তবে কাঁসা-পিতলের কাজটা প্রথম পুরুষ থেকেই ছিল। আমি কাজ শিখেছি বাবা ও দাদুর কাছে।” জানালেন সত্তর ছুঁই ছুঁই কাংসশিল্পী লালমোহন মণ্ডল।
বয়স শরীরে থাবা বসালেও শিল্পজ্ঞান এবং ধাতুবিদ্যা দুই-ই প্রখর ও সচল। পুথির বিদ্যা বকুলতলা জুনিয়র স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত। তার পরে পুরোপুরি পারিবারিক ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়া। সাংসারিক প্রয়োজনের পাশাপাশি শিল্প হিসাবেও তৈরি হতে থাকল নানা আকারের রকমারি জিনিসপত্র। সঙ্গে সব সময় চিন্তা, নতুন কী তৈরি করে সকলকে তাক লাগানো যায়। “দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সাগর মেলায় বেশি বিক্রি হত বর্ডার উঁচু বড় থালা, ‘সাগরী’। পিতলের ‘পেটা ঘট’। বড় থালা ‘বগি থালা’। কানা উঁচু বিরাট থালা ‘রাজভোগ’। কানার চার দিক অর্থাৎ বর্ডারে ছোট ছোট ঢেউ, ‘চিলমারি’। এক সময়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসত চিনে রাং (রাং ঝাল নয়)। এই ধাতুর ভাগ, দস্তা দু’কেজির সঙ্গে সাতাশ কেজি তামা। ভরনের পাত্রে থাকত দস্তা ৪৭ শতাংশ এবং তামা ৫৩ শতাংশ। পিতলে, দস্তা ৪০ শতাংশ এবং তামা ৬০ শতাংশ।” গড় গড় করে শিল্পের ‘ফরমুলা’ শুনিয়ে দিলেন লালমোহন।
প্রবীণ শিল্পীর কাছে জানা গেল, নবদ্বীপের কারিগররা এখনও খ্যাতি নিয়েই কাজ করছেন। জয় সাধু খাঁ, বিশু ঘোষ, রবি বিশ্বাস তরুণ প্রজন্মের কতগুলি নামও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু এই আধুনিক নিত্য পরিবর্তশীল সময়ে পিতল-কাঁসার তৈরি সামগ্রীর ভবিষ্যৎ কি? উত্তর এল, “এ যুগে এর ব্যবহার কমেছে সেটা সত্যি। এর জন্য ব্যবহারিক সমস্যাও কিছু রয়েছে। পিতল কাঁসার পাত্রকে ব্যবহারের আগে ও পরে বার বার মাজতে হয়। এমন তড়িৎ গতির যুগে সে সময় কোথায়? কিন্তু ঠাকুর দেবতার জন্যে থালা বাসন মায় পাদুকা, বড় বড় মঠ মন্দিরে এখনও এর কদর রয়েছে। সে কারণেই এই কারবার শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো হবেও না।” আশার কথা শোনালেন লালমোহন মণ্ডল। |