বোরো ধান কাটতে লোক লাগবে। কিন্তু লোক কোথায়? আগে যাঁরা এই সময়ে চাষির জমিতে খেতমজুরের কাজ করতেন, এখন তাঁদের অধিকাংশই তো একশো দিনের কাজে নিযুক্ত!
নতুন সরকারের আমলে রাজ্যে একশো দিনের কাজ গতি পেয়েছে। নির্ধারিত সময়-ভিত্তিক চাষের কাজে মজুরিও কম, তাই বহু খেতমজুর একশো দিনের কাজেই ঝুঁকেছেন। অতএব, ধান কাটা-ঝাড়া-বাছার কাজে লোকাভাব দেখা দিয়েছে। এবং সঙ্কটের পরিত্রাণে এসে গিয়েছে যন্ত্র কম্বাইন হারভেস্টার। ছোট-মাঝারি চাষির পক্ষে দামটা যদিও বেশি, প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা। তাই মূলত বড় চাষিরাই যন্ত্রটি কিনছেন। অন্যেরা তাঁদের থেকে ভাড়া নিয়ে কাজ চালাচ্ছেন।
তবে প্রাথমিক ভাবে কিছুটা অসুবিধে হলেও এর ফলে রাজ্যের কৃষিতে যন্ত্র ব্যবহারের নতুন একটা দিগন্ত খুলে গিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। ট্র্যাক্টর-পাওয়ারটিলারের সুফল চাষিরা আগেই পেয়েছেন। এ বার তালিকায় জুড়েছে কম্বাইন হারভেস্টার। উপরন্তু বাম আমলের গোড়ায় ব্যাঙ্ক-সহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার চালু করতে গিয়ে যে ‘বাধা’ এসেছিল, হারভেস্টারের বেলায় তেমনটি না-আসাই স্বাভাবিক।
কারণ, তিন দশক আগে বামেদের সেই কম্পিউটার-বিরোধিতার সময়ে যে ‘কর্মী সঙ্কোচন’-এর আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল, এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। কর্মীর অভাব মেটাতেই এসেছে যন্ত্র। |
যন্ত্রের সাহায্যে চলছে ধান কাটা। দুর্গাপুরের জাগুলিপাড়ায় বিকাশ মশানের তোলা ছবি। |
বস্তুত কৃষিতে অগ্রসর বিভিন্ন রাজ্যে এই ‘পরিবর্তন’ আগেই এসেছে। সেখানে ফসল কাটা, তোলা, ঝাড়া থেকে শুরু করে বস্তাবন্দিও করা হচ্ছে যন্ত্রে। এবং উন্নত কৃষি-প্রযুক্তিরই এক নমুনা এই কম্বাইন হারভেস্টার। একাধিক বেসরকারি সংস্থা এখন পশ্চিমবঙ্গে এটি বিপণনে কোমর বেঁধে নেমেছে। সম্প্রতি বর্ধমানে কৃষি দফতর আয়োজিত এক প্রদর্শনীতেও অন্যতম দ্রষ্টব্য ছিল কম্বাইন হারভেস্টার। চাষিরা ভিড় করেছেন তার চারপাশে। তাঁদের বক্তব্য, “খুবই উপযোগী জিনিস। কিন্তু দামটা বেশি বলে অল্প লোকই একা কিনতে পারবেন।” তাই সমবায় গড়ে বা কয়েক জন মিলে কেনার কথা ভাবা হচ্ছে। ব্লকে ব্লকে হারভেস্টার কিনতে চাষিদের ভর্তুকি দেওয়ার দাবিও উঠছে।
বড় চাষিরা অনেকে অবশ্য ব্যাঙ্ক-ঋণ নিয়ে কম্বাইন হারভেস্টার কিনছেন। যেমন বর্ধমানের ভাতারের সুবোধ কোনার এ বছরেই কিনে ফেলেছেন দু’টো। সুবোধবাবু বলছেন, “নিজের কাজ তো হচ্ছেই, ভাড়াও খাটাচ্ছি। এতে বিস্তর সুবিধে। খরচও কম। এক বিঘে জমির ধান কাটতে-ঝাড়তে পড়ছে মোটামুটি হাজার টাকা। যেখানে মজুরি পড়ত প্রায় তিন হাজার। যন্ত্রে সময়ও কম লাগছে।”
তাই লোকাভাবের জমানায় হারভেস্টারের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুধু ধান নয়, অন্যান্য ফসলেও এটি সমান কার্যকর হওয়ায় বছরভরই কাজে লাগবে।
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “একশো দিনের কাজের জন্য চাষে লোক মিলছে না। যন্ত্রের ব্যবহার তো হবেই!”
তবে এই কারণে প্রকল্পটি বন্ধ করার কোনও প্রশ্ন নেই বলে জানিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গ কিসান ও খেতমজুর কংগ্রেসের সভাপতি দেবাশিস দত্তও বলেন, “ওই প্রকল্পের জন্য খেতমজুরের অভাব দেখা দিচ্ছে ঠিকই। আর তার বিকল্প হিসেবে যন্ত্রের ব্যবহার স্বাভাবিক।” প্রবীণ কৃষিশ্রমিক কাশীনাথ সেনের মন্তব্য, “একশো দিনের কাজে মজুরি বেশি (১৩০ টাকা), চাপও কম। তাই চাষের কাজে আকর্ষণ কমেছে।” অনেকের মতে, কৃষি-মজুরি বাড়লে লোকের সমস্যা মিটবে বটে, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ মানুষ এখন অন্যান্য পেশার খোঁজেও অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছেন। এবং বাইরে যাওয়ার এই প্রবণতা দিন দিন বাড়বে বই কমবে না। বিশেষজ্ঞেরা কী বলেন?
সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্রের বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রে এই পরিবর্তন স্বাভাবিক ও ইতিবাচক। কৃষিতে খেতমজুর নির্ভরতা কমছে, আসছে যন্ত্র। ফলে খেতমজুরেরাও অন্য পেশার জন্য নিজেদের তৈরি করতে পারছেন। বিভিন্ন সুযোগ তাঁদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে।” কৃষি-বিজ্ঞানী রথীন্দ্রনারায়ণ বসুর মন্তব্য, “যন্ত্রকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তবে এ রাজ্যে ছোট জমি বেশি, তাই এর ব্যবহার পুরোপুরি সফল হবে কি না, এখনই বলা যায় না।” নির্মাতারা অবশ্য জেনে গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করতে হলে হারভেস্টারকে ছোট জমিতেও জনপ্রিয় করতে হবে। এক সংস্থার দাবি, তারা এমন হারভেস্টার বার করেছে, যাতে পাঁচ কাঠা জমির ধানও কাটা-ঝাড়া যাচ্ছে।
অর্থাৎ, দেরিতে হলেও কম্পিউটারের মতো কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার গতি পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। |