|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
‘কিন্তু নারীর নিজের যৌনতাটা দোষের’ |
এই বাংলায় মেয়েদের স্মৃতিকথা-আত্মকথার প্রকাশ আস্তে আস্তে বাড়ছে। তাতে মেয়েদের প্রতিরোধ-বশ্যতা সরবতা-নীরবতা আনন্দ-বিষাদ বা সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনির তলায় লুকনো যে জটিলতা, তার খোঁজেই রুশতী সেনের নতুন বই পরাণের আলো ভুবনের আঁধার/ মায়েদের কথা মেয়েদের কথা (পত্রলেখা, ১৭০.০০)। যদিও মুখবন্ধ-এ লেখক জানাচ্ছেন ‘আমার লেখাটা এখানে একান্তই গৌণ; আসল কথা হল, ওইসব কথকতার সঙ্গে পাঠকের চেনা-পরিচয় যেন নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়।’ কিন্তু সেই চেনা-পরিচয়ের ফাঁকে ফাঁকেই লুকনো জটিলতার সন্ধান জুগিয়ে যান লেখক, যেমন প্রথম প্রবন্ধ ‘শিক্ষিত বাঙালি মেয়ে: গতি ও প্রকৃতি’তে তাঁর মন্তব্য: ‘বিশ শতকের বিভিন্ন সময়ে সংস্কৃতির বিচিত্র ক্ষেত্রের গুণী মেয়েরা যেসব জীবনকথা কিংবা জীবনকাহিনির বিকল্প লিখেছেন, সেখানে একটি আয়োজন যেন বড় বেশি প্রত্যক্ষ; কত কম বলা যায় নিজের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত সব নিরাবরণ সত্যি!’ আবার কীর্তিময়ী মেয়েদের আত্মকথা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন ‘কীর্তিময়ীদের অন্দরে-বাইরে কোন উভটানের কোন দাবি কতখানি, সে-হদিস বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে আজ পর্যন্ত নিরাবরণ গ্রথিত হয়নি।’ আর-একটি প্রবন্ধ ‘বাঙালি মেয়েদের সাম্প্রতিক গদ্যচর্চা: একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন’-এ নিজের মত স্পষ্ট করে তুলেছেন আরও: ‘আসলে নারীত্ব, বিশেষত বাঙালি মেয়ের নারীত্ব বলতে কিছু পূর্বনির্ধারিত ধারণা আমাদের ঘিরে রাখে। এই ঘেরকে অস্বীকার করা সংসারে, সমাজে, শিল্পসাহিত্যে কোথাও-ই বড় সহজ নয়।’ এই সূত্রে তাঁর আলোচনায় আসেন আলপনা ঘোষ তৃপ্তি সান্ত্রা জয়া মিত্র মীনাক্ষী সেন অনিতা অগ্নিহোত্রীর মতো আখ্যানকারেরা। আর নাম-প্রবন্ধটি জুড়ে কেবল সুনন্দা সিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ নিয়ে আলোচনা।
নিস্তারিণী দেবীর (১৮২৫-১৯১৫) সেকেলে কথা (সম্পা: অশোক চট্টোপাধ্যায়। চিরায়ত, ৬০.০০) প্রকাশ পেয়েছে। সম্পাদক তাঁর ভূমিকায় জানিয়েছেন ‘‘কুলীন বংশের মেয়ে হয়ে জন্মানোর কী পরিণতি হতে পারে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলায়, নিস্তারিণী তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। নয়-দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল প্রায় তিরিশটি বিবাহকারী বছর পঁচিশের এক যুবকের সঙ্গে। নিস্তারিণীর বয়স যখন চোদ্দো বছর তখন স্বামী প্রয়াত হন। পরবর্তী ছিয়াত্তর বছর নিস্তারিণী বৈধব্যজীবন যাপন করেছেন, ভাইদের সংসারে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেছেন, শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে কাশীতে প্রয়াত হয়েছেন।... নিস্তারিণীর ভাই রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র মন্মথধন বন্দ্যোপাধ্যায় একটা উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন নিস্তারিণীর মুখনিঃসৃত ‘সেকেলে কথা’ লিপিবদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে।... মন্মথধনের চেষ্টায় ও প্রযত্নে নিস্তারিণী কথিত ‘সেকেলে কথা’ ভারতবর্ষ পত্রিকায় মোট সাতটি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়।”
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে মেয়েদের অবস্থান, এদেশের ও বাংলাদেশের নারী আন্দোলন, উপনিবেশবাদ প্রান্তিকতা বা লিঙ্গবিষয়ক ভাবনার প্রেক্ষিতে মেয়েরা, নারী নিগ্রহ, ভারতীয় আইনে মেয়েদের অধিকার, মুসলিম মেয়েদের আইনি অধিকার, স্বায়ত্তশাসনে মেয়েদের ভূমিকা, অসংগঠিত নারীশ্রমিক, বিজ্ঞাপনে ও মিডিয়া-য় মেয়েরা, শিল্প-সাহিত্যে নারীচিত্রণ ইত্যাদি নানা দিক থেকে মেয়েদের নিয়ে আলোচনা নারীপৃথিবী: বহুস্বর (উর্বী, ৫০০.০০) বইটিতে। সম্পাদক বাসবী চক্রবর্তী প্রাক্কথন-এ জানিয়েছেন ‘যাঁরা নারী-পৃথিবীকে জানতে চান তাঁদের জন্যই এই গ্রন্থ। নারী বিষয়ক পঠন-পাঠনে যাঁরা নিয়োজিত তাঁদের প্রয়োজনেও এই বই।’
মাধবী মাইতির মিথ্যা গোপনীয়তা নৈঃশব্দ্য/ অবলা সন্দর্ভ (প্যাপিরাস, ২৫০.০০) বইটির বিষয়: নারী-নির্মাণ। যে ভাবে ক্ষমতাতন্ত্র নিজস্ব গতিতে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে বানিয়ে তোলে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, তার ওপর কায়েম করে পিতৃতন্ত্র, সে সব নিয়েই এ-বই। প্রাক্কথনে লেখক জানিয়েছেন ‘চেষ্টা করলাম নারী নির্মাণের একটা সামাজিক ইতিহাসকে ধরতে। মূলত বাংলার প্রেক্ষিতে।’ শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাত্ত্বিক ভাবে ঋণী, এ-কথা স্বীকার করে লেখক বহুবিধ অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন বইটিকে। যেমন একটি অধ্যায়: ‘ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক’। তাতে লিখছেন ‘‘নৈতিকতার এই মানদণ্ড তৈরি করেছেন ক্ষমতাবান পুরুষ। এই নির্মাণের ইতিহাস বহু পুরনো। শুধুমাত্র উপনিবেশের পুরুষই নারীকে ‘কামিনী’, ‘রমণী’ বলে অভিহিত করেছেন তা নয়; যে দিন থেকে ক্ষমতা পুরুষের হাতে চলে গেছে সেদিন থেকেই নারী যৌন সামগ্রী। কিন্তু তাঁর নিজের যৌনতাটা দোষের। এমনকি যৌন বিষয়ক কথা তো দূরের কথা, যৌনতা শব্দটাই উচ্চারণের যোগ্য নয় ভদ্রমহিলাদের কাছে। এই ধরনের দ্বিচারিতা তো আছেই, এছাড়া নিষ্ঠুরতা, ঔদাসীন্য, নিপীড়ন, বঞ্চনা এগুলোও শাসক শ্রেণিরই ধর্ম। আমাদের সংস্কৃতিতে একে ‘রাজধর্ম’ বলে সম্মান করা হয়।” |
|
|
|
|
|