|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
পাওলিও বাঁচাতে পারলেন না |
উপন্যাসের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়াল ক্যামেরা। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
২৫শে বৈশাখের পরের সপ্তাহেই মুক্তি পেয়েছিল বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত, পাওলি দাম অভিনীত রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস, যার সিনেমার নাম ‘এলার চার অধ্যায়’। বলা যায় বাঙালির যৌথ আবেগের যথাসর্বস্ব হলেন তিনি, রবি ঠাকুর। এই সার্ধশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে যাবতীয় চর্চা একটা শিখর ছুঁয়ে ফেলেছে। দিকে দিকে শুধুই তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান, একের পর এক তাঁর স্মরণসভা, তাঁর ওপর বক্তৃতাসভা, প্রেক্ষাগৃহে-প্রেক্ষাগৃহে তাঁর নাটক, তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি সিনেমা।
এই পার্বণের পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে বাপ্পাদিত্যর সিনেমা তৈরিটা একই সঙ্গে যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক ছিল। ‘চার অধ্যায়’ এমনিতেই একটা জটিল উপন্যাস। দেশকে স্বাধীন করা, সশস্ত্র বিপ্লবের মতো উচ্চাকাঙ্খাকেও কী ভাবে নারী-পুরুষের সম্পর্কের আবর্তে পড়তে হয়, নিয়ন্ত্রিত হতে হয়, নারীর মোহ, প্রেম, শরীর কী করে তার চরিত্র বদলে দেয়, তাই নিয়েই উপন্যাস। কিন্তু উদ্যোগে ফাঁক রয়ে গেল কারণ অত বড় বিষয়টাকে প্রায় অন্তরালে রেখে ছবিটা সম্পন্ন করলেন বাপ্পাদিত্য। দু’-একবার ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি ছাড়া দু’টো বন্দুক ধরার দৃশ্য ও একটি লাঠি ঠোকাঠুকির দৃশ্য ছাড়া বাকি বিপ্লবটা অবহেলিত রয়ে গেল। সেটা বাদ দিলে, উপন্যাসের আসল প্রেক্ষাপট সরিয়ে নিলে উপন্যাসটার আর থাকেটা কী? |
|
এলার চার অধ্যায়
পাওলি, রুদ্রনীল, ইন্দ্রনীল, বিক্রম |
দেশ বড়, আত্মত্যাগ বড়, না প্রেম-ভালবাসা-বিয়ে বড়, এই প্রশ্নগুলোর তখন দিশেহারা অবস্থা হওয়ারই কথা।
বাপ্পাদিত্যর ‘এলার চার অধ্যায়’-য়ের প্রথম দৃশ্যটা দেখে মনে আশা জেগেছিল যে অতঃপর রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসটিকে পর্দায় তার ব্যুৎপত্তি ও প্রকৃতি সহ ততটাই জ্বলে উঠতে দেখব যতটা জ্বলে উঠেছিল এই বঙ্গদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়। কিন্তু অতি দুর্বল চিত্রনাট্য সেই আশার আগুনে জল ঢেলে দিল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করতে গেলে যে শুধু পিরিয়ড পোশাক পরা নারী-পুরুষ আর আসবাবপত্রকে একটা পুরনো বাড়িতে একত্রিত করে ‘স্টার্ট ক্যামেরা’ বলাই যথেষ্ট নয়, রচনার বোধ, এবং একমেবাদ্বিতীয়ম অন্তঃকরণটিতেও হানা দেওয়া দরকার তা বাপ্পাদিত্যকে মনে না করিয়ে দিয়ে পারছি না। নিষ্ঠা ও পরিশ্রমজাত ঘর্ষণটির অভাব বড় টের পেলাম ছবিটা দেখতে দেখতে। প্রয়োজন ছিল সংলাপের পুনর্লিখন। উপন্যাসের পাতায় পাতায় মাথা ঠুকে ঘুরে বেড়াল ক্যামেরা। একটা সিনেমা হয়ে উঠল না। অবশ্য বাপ্পাদিত্যের রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসকে প্রায় থিয়েটারি ঢঙে চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে আনা রবীন্দ্র অনুরাগী কিছু দর্শককে প্রীত করতে সমর্থ হলেও হতে পারে।
পাওলি দামের মতো অভিনেত্রী, যাঁর যে কোনও ধরনের চরিত্রেই নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে, যিনি ‘হেট স্টোরি’র মতো ছবিতেও শেষ দৃশ্য পর্যন্ত লড়ে গেছেন, সেই পাওলি অভিনীত এলার চরিত্রটিতেও রক্তমাংসে প্রাণসঞ্চার হতে দেখা গেল না! রবীন্দ্রনাথের নারীমাত্রেই কি আরোপিত ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী? তারা কি হাত-পা-ও পর্যাপ্ত পরিমাণে নাড়াবে না? এমন কি রুদ্রনীলের মতো অভিনেতাকেও অসহায় করে রেখে দিলেন বাপ্পাদিত্য।
এ ছাড়া বিক্রম চট্টোপাধ্যায়ের অতীন সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ভাল। তাঁর উচ্চারণও তেমন স্পষ্ট নয়। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তও তথৈবচ। দর্শক ‘দেশ অর্ধনারীশ্বর, নারী-পুরুষের মিলনেই তার মুক্তি’ দৃশ্যটার কথা একবার ভাবুন। এ সব দৃশ্যও উত্থান-পতনহীন। ধীর গতির এই ছবির অবশ্য কিছু প্রাপ্তি আছে। তার মধ্যে প্রথম হল দীপঙ্কর দে’র অভিনয় আর পাওলির উপস্থিতি। তা ছাড়া গৌতম বসুর শিল্প-নির্দেশনা এবং রানা দাশগুপ্তর সিনেমাটোগ্রাফিও চোখ টানে। আর যাঁদের একান্তই সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন তাঁরা এই ছবির সঙ্গীত পরিচালকদ্বয় গৌরব চট্টোপাধ্যায় ও আব্রাহাম মজুমদার। ‘আয় তবে সহচরী, হাতে, হাতে ধরি ধরি’ গানটা খুবই ভাল গেয়েছেন সোমলতা আচার্য চৌধুরী।
আর ভাল লেগেছে সায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাঝে, মাঝে তব দেখা পাই’। |
|
|
|
|
|