|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
উপস্থাপিত হয়েছে দেশের সামাজিক সংকট |
সিমায় চলছে ‘পঞ্চ সেনা’ শীর্ষক পাঁচ জন শিল্পীর সম্মেলক প্রদর্শনী। ঘুরে এলেন মৃণাল ঘোষ। |
ফরাসি কবি মালার্মে বলেছিলেন, কবিতা গড়ে ওঠে ‘শব্দ’ দিয়ে। ছবি সম্পর্কেও এ রকম ভাবেন অনেক তাত্ত্বিক যে, ছবির প্রধান উপাদান ‘ইমেজ’ বা প্রতিমাকল্প। সিমা গ্যালারিতে এখন চলছে ‘পঞ্চ সেনা’ শিরোনামে মুম্বই ভিত্তিক পাঁচ জন তরুণ শিল্পীর ছবি নিয়ে যে প্রদর্শনী তার ভূমিকা-স্বরূপ উপস্থাপনায় উদ্ধৃত করা হয়েছে ডেভিড ফ্রিডবার্গের একটি উক্তি, যাতে তিনি বলেছেন ‘দ্য পাওয়ার ইজ উইথ দ্য ইমেজেস’। তা হলে প্রশ্ন জাগে শিল্পের নির্মাণে ‘আইডিয়া’, ‘কনসেপ্ট’ বা ভাবনার অবস্থান কি অপেক্ষাকৃত গৌণ? এ কথা ঠিক শুধু ‘আইডিয়া’ দিয়ে শিল্প হয় না, যদি না শব্দ বা ইমেজ সেই ভাবনার প্রকৃষ্ট বাহন হয়ে ওঠে। সফল চিত্রকলায় প্রতিমাকল্পই ভাবনাকে স্পন্দিত করে। ভাবনার ভিতর প্রাণ সঞ্চার করে। এই দুইয়ের সুষ্ঠু সমন্বয় যে কোনও শিল্পের প্রাথমিক শর্ত।
শিল্পীরা হলেন সঞ্জীব সোনপিম্পারে, রোউল হেমন্ত, সন্তোষ মোরে, তুষার পোত্দার ও পণ্ডিত ভিলা খয়রনার। মুম্বই শহরের সাম্প্রতিক বিপন্ন বাস্তবতা তাঁদের প্রতিমাকল্প নির্মাণের মূল ভিত্তিভূমি। মুম্বই যেহেতু ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র, তাই আজকের বিশ্বায়নজনিত সংকটের সবচেয়ে প্রগাঢ় প্রতিফলন দৃশ্যমান হয় এই শহরে। শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদী প্রতিমাকল্পে একটি শহরকে ভিত্তি করে সারা দেশের সামগ্রিক সংকটকে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।
সঞ্জীব সোনপিম্পারে (১৯৬৯) মুম্বইয়ের জে.জে. স্কুল অব আর্ট-এর স্নাতক। তাঁর ছবিতেই প্রতিমাকল্প সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট ভাবে বাস্তবতার নিগূঢ় শূন্যতাকে প্রতীকায়িত করেছে। তাঁর ১১টি ছবি দু’রকম আঙ্গিক ও কৃৎকৌশলে করা। কতকগুলি ছবির প্রতিমাকল্প বিশ্লিষ্ট মানব-অবয়ব ভিত্তিক। সেগুলি তিনি এঁকেছেন চটের বস্তার উপরে অ্যাক্রিলিক ও পলিস্টার রেজিনে। এই চটের বস্তায় খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও গুদামজাত করা হয় এবং পরে বিপণনের জন্য সরবরাহ করা হয়। শেষ পর্যন্ত তা আর দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছায় না। এখানে কিন্তু আইডিয়াই ইমেজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ রকমই একটি ছবিতে দেখি কঙ্কালসার অভুক্ত একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটি মাইক্রোফোনের মাউথপিস। যেন বর্ষিত হচ্ছে উচ্চকিত ভাষণ। দ্বিতীয় ধারার ছবিতে কাগজের উপর তিনি সরাসরি ধান, চাল, গম ইত্যাদি বিভিন্ন শস্যদানা সেঁটেছেন। তার উপর ইংরেজি অক্ষরে লেখা হয়েছে আজকের জীবনযাপনের কিছু অপরিহার্য শব্দাবলি যেমন ‘র্যাশন কার্ড’, ‘প্যান কার্ড’ ইত্যাদি।
|
|
শিল্পী: সঞ্জীব সোনপিম্পারে |
রোউল হেমন্ত (১৯৭৭) ওড়িশার বেরহামপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় ২০০০-এর স্নাতক। ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিকে আঁকা তাঁর পাঁচটি ছবির প্রধান বিষয় অভিবাসী শ্রমিক, যারা গ্রাম থেকে বড় শহরে আসে কাজের সন্ধানে এবং ক্রমে বিপন্নতার অন্তিমে পৌঁছায়। ‘স্লাম গডস’ ছবিতে চিত্রপট জুড়ে একটি নরকঙ্কাল গড়ে উঠেছে হাঁড়ি, কলসি, ঘটি, বাটি ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রীর পারস্পরিক সংযুক্তিতে। পিছনের দেওয়ালে সিনেমার পোস্টারে যৌনতাময় যুবতীর ছবি। বিশ্লিষ্ট ‘ইমেজ’ এখানে সংক্ষুব্ধ ‘আইডিয়া’য় রূপান্তরিত হল।
সন্তোষ মোরে (১৯৬৯) মুম্বইয়ের জে.জে. স্কুলের ১৯৯২-এর স্নাতক। তাঁর দশটি কাজের মধ্যে ‘ক্যামোফ্লেজ’ শিরোনামে সাতটি ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিক ও বালি দিয়ে রচিত চিত্রপ্রতিমা। ‘প্রহিবিটেড’ শীর্ষক তিনটি কাজ ইনস্টলেশনধর্মী ভাস্কর্য। শহরের স্থাপত্যের ভিতর যে অমানবিক শূন্যতা পরিব্যাপ্ত থাকে, সেটাকেই তিনি জ্যামিতিক প্রতিমাকল্পের বিভিন্ন বিন্যাসে ধরতে চেয়েছেন। ইনস্টলেশনে এই সভ্যতার অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন।
তুষার পোত্দারও (১৯৭৯) জে.জে. স্কুলের ছাত্র। পাশ করেছেন ২০০১-এ। তাঁর ছ’টি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসের শিরোনাম ‘ট্রমা’। সমতল বর্ণে লিপ্ত প্রেক্ষাপটে শূন্যতা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। তার উপর সংস্থাপিত হয়েছে মুখ। নৈর্ব্যক্তিক, শঙ্কাদীর্ণ, নৈরাশ্যময়। সেই মুখের দিকে চার পাশ থেকে তর্জনী উঁচিয়ে থাকে। শহরের নিঃসীম বিমানবিকতাকে এ ভাবেই পরিমিত প্রতিমাকল্পে ধরতে চেয়েছেন তিনি।
মুম্বইয়ের রহেজা স্কুল অব আর্ট থেকে ১৯৯২-তে চিত্রকলায় ডিপ্লোমা নিয়েছেন খয়রনার (১৯৬৮)। ‘ডি-ক্লাটার’ শিরোনামে তাঁর ছ’টি তেলরঙের ক্যনভাসেই বিমূর্ত চিত্রকল্পের উপস্থাপনা। নিসর্গের দূরতর আভাস রয়েছে সেখানে। রয়েছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বর্ণিল আলো। প্রকৃতিতে সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার ইঙ্গিত থাকে। মানুষ তাকে ধ্বংস করে। শূন্যতার এই করুণায় স্পন্দিত হয় তাঁর নিরাবয়ব প্রতিমা।
প্রতিমাকল্পের পাঁচ রকম বিন্যাসে সত্যের উপর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলো ফেলতে চেয়েছেন পাঁচ জন শিল্পী। ‘রূপ’কে ‘ভাব’-এ রূপান্তরিত করেছেন। |
|
|
|
|
|