এক দিকে অর্থনীতির যুক্তি, অন্য দিকে রাজনীতির বাধ্যবাধকতা এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলার পথ খুঁজছে মনমোহন সিংহের সরকার। আর সেই কাজে নেমে অর্থনীতিকেই হাতিয়ার করছে তারা। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি এ দিন ইঙ্গিত দেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আমজনতাকে কিছুটা সুরাহা দেওয়ার চেষ্টা করবে সরকার। তবে সেটা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার অবমূল্যায়ন এবং অশোধিত তেলের দামের উপরেই। রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কথা মেনে নিয়েও তাঁর বক্তব্য, এই পরিস্থিতিতে তাই ‘রোল ব্যাক’ নিয়ে আজ স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
পেট্রোলের দাম লিটারপিছু এক লাফে সাড়ে সাত টাকা বাড়ার পরে বিরোধীরা তো বটেই, শরিক ও সমর্থকেরাও রাস্তায় নামছেন। আগামিকাল, শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিবাদ পদযাত্রায় সামিল হচ্ছেন। ৩১শে উত্তরপ্রদেশ বন্ধের ডাক দিয়েছে আর এক সহযোগী মুলায়ম সিংহের দল সমাজবাদী পার্টি। ইউপিএ সরকারের দুই বড় ভরসা এমন পদক্ষেপ করায় আজ কেন্দ্র প্রথম বারের জন্য তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার কাজে নেমেছে। সেই লক্ষ্যে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি জানিয়েছেন, কয়েক সপ্তাহ নয়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সব দিক দেখে মানুষকে সুরাহা দিতে চাইছেন তাঁরা। তবে সেটা যে টাকা ও অশোধিত তেলের দামের উপরে নির্ভরশীল, সেটাও জানাতে ভোলেননি। তাঁর বক্তব্য, আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম কমলে এবং টাকার দাম বাড়লে, পেট্রোলের দাম কিছুটা কমানো সম্ভব। তাই একে ‘রোল ব্যাক’ বলে মানতে নারাজ কেন্দ্র। একই সঙ্গে অবিলম্বে ডিজেল ও রান্নার গ্যাসেরও দাম বাড়ানোও উচিত বলে জানিয়ে দিয়েছেন রেড্ডি।
পেট্রোলের দাম বাড়ানোটা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত হয়, তা হলে কিছুটা দাম কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে কেন? এখানে অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দিকেও ইঙ্গিত করেন জয়পাল। বলেন, “এটা রাজনীতি, পদার্থবিজ্ঞান নয়।” পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ১ জুন এমনিতেই তেল সংস্থাগুলি নিয়মমাফিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসবে। সেই দিনই দাম কমানো যেত। কিন্তু তার আগের দিন, ৩১ মে বিজেপি ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে। বামেরাও ওই দিন দেশ জুড়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নামবে। তা ছাড়া, মমতা-মুলায়মের আন্দোলন তো আছেই। |
• আজ, শনিবার প্রতিবাদ-পদযাত্রা করবেন মমতা
• ৩১ মে উত্তরপ্রদেশ বন্ধ ডেকেছেন মুলায়ম
• ৩০ মে পেট্রোলের দাম
কিছুটা কমানো হতে পারে
• দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সঠিক, জোরালো সওয়াল জয়পাল রেড্ডির
• ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দামও বাড়ানো হতে পারে, জানালেন
জয়পাল রেড্ডি
কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রাজ্য। |
|
ফলে ১ জুন পেট্রোলের দাম কমানো হলে, শরিক-বিরোধীরাই সব কৃতিত্ব নিত। তাই বন্ধের আগের দিন ৩০ মে দাম কমানো হতে পারে। তবে তা হলেও, দাম কমানোর পরিমাণ কোনও ভাবেই লিটার প্রতি দেড় থেকে দু’টাকার বেশি হবে না বলেই মন্ত্রক সূত্রের খবর।
সরকারি সূত্রের বক্তব্য, এতে দু’কূলই রক্ষা পাবে। এক দিকে শরিক দল ও সমর্থকদের উদ্বেগে সরকার সাড়া দিল, সেই বার্তাও দেওয়া যাবে। আবার দাম সামান্য কমানোর পরেও লিটার প্রতি অন্তত সাড়ে পাঁচ টাকা বাড়তি আয় হবে তেল সংস্থাগুলির।
কেন ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কেন্দ্রকে? পেট্রোলিয়াম মন্ত্রীর যুক্তি, টাকার অবমূল্যায়ন ও অশোধিত তেলের ক্রমবর্ধমান দামের ধাক্কা লেগেছিল অর্থনীতিতে। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি লোকসানে চলতে চলতে ভেঙে পড়ুক, তা সরকার হতে দিতে পারে না। আবার মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সে বিষয়েও সরকার নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। জয়পালের বক্তব্য, “আমরা আরও কয়েক দিন পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে চাইছি। টাকা ও তেলের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হলে তবেই অন্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হবে।”
এর পাশাপাশি করের বোঝা কমানোর সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখতে চাইছে মনমোহন-সরকার। পেট্রোলের দামে শতকরা ৪০ ভাগই কেন্দ্র ও রাজ্যের কর। গত বছর আমজনতাকে সুরাহা দিতে কেন্দ্র একদফা কর কমিয়েছিল। কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলিকেও কর কমানোর কথা বলা হয়েছে। কেরল ও উত্তরাখণ্ড ইতিমধ্যেই সেই পথে হেঁটেছে। কিন্তু কেন্দ্র বুঝতে পারছে, সব রাজ্যকে বললেই তারা কর কমিয়ে ফেলবে না। কারণ এতে রাজ্যের নিজস্ব আয় কমে যাবে। তাই সংঘাতের পথে না গিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করেই এগোতে চাইছে কেন্দ্র। আজ জয়পাল রেড্ডির সঙ্গে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এ বিষয়ে আলোচনা হয়। ঠিক হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে পৃথক ভাবে আলোচনা করবেন প্রণব-জয়পাল। সব রাজ্যকে চিঠি লিখে কর কমাতে অনুরোধও করা হতে পারে। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনও ডাকা হবে। বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রধান শরিক দলের মুখ্যমন্ত্রীর মতামতকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্র। পাশাপাশি কংগ্রেসের কোর কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়েছে, দেশের আর্থিক সঙ্কট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। এ দিকে কলকাতায় মহাকরণ সূত্রের খবর, পেট্রোলের দাম কমানো নিয়ে ইঙ্গিত পাওয়ার পরে কেন্দ্র কী করছে, তা দেখেই রাজ্য সেস বা কর কমানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে জয়পাল মনে করছেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, উভয় পক্ষকেই কিছুটা করে রাজস্ব ক্ষতি মেনে নিতে হবে।
রাজনীতি বনাম অর্থনীতির এই লড়াইয়ে সব থেকে অস্বস্তিতে পড়েছে কংগ্রেস। বিরোধী এবং শরিকরা রাস্তায় নামতে পারলেও, কংগ্রেসের পক্ষে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে সরব হওয়া সম্ভব নয়। তাই কংগ্রেসের নেতারা এক দিকে দাম বাড়ানোর পিছনে অর্থনৈতিক যুক্তি দিচ্ছেন, আবার অন্য দিকে সরকার দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষকে সুরাহা দেবে বলেও আশা প্রকাশ করছেন। তবে মমতা-মুলায়ম যে প্রতিবাদ আন্দোলনেই সামিল হোন না কেন, ইউপিএ এখনও অটুট বলেই কংগ্রেস নেতাদের দাবি। তাঁদের যুক্তি, ২২ মে ইউপিএ-র তৃতীয় বর্ষপূর্তির নৈশভোজে মুলায়ম এসেছেন। আবার মমতাও সরকারকে অস্থির করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
এ দিন ডিজেলের দাম বাড়ানোর পক্ষেও সওয়াল করেন জয়পাল। ডিজেলের দাম শেষ বেড়েছিল গত বছরের জুন মাসে। কিন্তু সেই পথে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বড় বাধা। তার মেনে নিয়ে জয়পাল বলেন, “রাজনীতি ও যুক্তি, একসঙ্গে যায় না। অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী কী প্রয়োজন, তা সকলেই জানেন।” |