প্রবল দাবদাহে অতিষ্ঠ এখন উত্তরবঙ্গও। বালুরঘাট, মালদহ, রায়গঞ্জ, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়িতেও তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ চড়ছে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, গত ৩ বছরের হিসেব ধরলে এবার ‘রেকর্ড’ গরম পড়েছে। সরকারি সূত্রের খবর, তাপ প্রবাহে ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধের কথা মাথায় রেখে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সরকারি স্কুল মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই ছুটি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দক্ষিণবঙ্গে সেই নির্দেশ মেনে সরকারি স্কুল তো বটেই, সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও গরমের ছুটি দেওয়া হয়েছে। অথচ উত্তরবঙ্গের ৬ জেলার অর্ধেক স্কুলেই গ্রীষ্মের ছুটি দেওয়া হয়নি। বিশেষত, জলপাইগুড়িতে অধিকাংশ স্কুলই খোলা। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্র বলেন, “কিছু স্কুল সরকারি নির্দেশ মেনে গরমের ছুটি এগিয়ে আনেনি। জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।” জলপাইগুড়ির জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) নারায়ণ সরকার জানান, তাঁরা বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে কারণ জানতে চেয়েছেন। এমতাবস্থায় তীব্র দাবদাহে স্কুলে যাতায়াত করতে চরম হয়রান হচ্ছে পড়ুয়ারা। এমনকী, গরমে স্কুলের মধ্যে পড়ুয়া, শিক্ষিকাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও জলপাইগুড়িতে ঘটছে। বাড়ছে পেটের রোগও। তাই দ্রুত স্কুলগুলিতে গরমের ছুটি দেওয়ার দাবিতে সরব হয়েছেন অভিভাবকেরা। আলিপুরদুয়ার অভিভাবক মঞ্চের সভাপতি ল্যারি বসুর অভিযোগ, সাধারণত জুনের মাঝামাঝি উত্তরবঙ্গে গরমের ছুটি হয় বলে গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার টিকিট কেটে রাখেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ। ল্যারিবাবু বলেন, “আমার কাছে খবর রয়েছে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে নেতানেত্রী স্থানীয়দের একাংশের বাধায় সরকারি নির্দেশ কার্যকর হয়নি। অবিলম্বে গরমের ছুটি দেওয়া না-হলে আমরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব।” |
শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ি মিলিয়ে অন্তত ৪০০ স্কুলে গরমের ছুটি দেওয়া হয়নি। একাধিক স্কুল সূত্রে জানানো হয়েছে, স্কুলে ইউনিট টেস্ট চলতে থাকায় এখন ছুটি ঘোষণা সম্ভব নয়। জলপাইগুড়ির সুনীতিবালা সদর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অপর্ণা বাগচী বলেন, “সরকারি নির্দেশ পেয়েছি। তবে স্কুলে ইউনিট টেস্ট চলছে। তা ছাড়া, সরকারি নির্দেশে ছুটি দিতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই।” ডুয়ার্সের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুভাষ সেনগুপ্ত ও ধূপগুড়ির রাজামোহন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তাপস ভদ্র প্রায় একই সুরে বলেন, “দক্ষিণবঙ্গের মত এখানে তেমন গরম নেই। সে কারণে পরিচালন কমিটির সিদ্ধান্তে পূর্ব নির্ধারিত সূচি মেনে জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে গ্রীষ্মের ছুটি দেওয়া হবে।” এই ব্যাপারে মাধ্যমিক শিক্ষা ও শিক্ষা কর্মী সমিতির জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক (এসটিইএ) কনৌজ বল্লব গোস্বামী বলেন, “রাজ্য সরকারের নির্দেশ সরাসরি অমান্য করা হচ্ছে। এখন জেলার তাপ মাত্রা ৩৬-৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। একজন ছাত্র অসুস্থ হলে সে দায়িত্ব প্রধান শিক্ষকদের নিতে হবে। যে সমস্ত প্রধান শিক্ষক নির্দেশ মানছেন না তাঁদের শো-কজ করা উচিত।” কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, গত রবিবার জলপাইগুড়ি শহর ও লাগোয়া এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকের থেকে চার ডিগ্রি বেশি. ২০০৯ সালে মে মাসে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি মতো সমতল এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১০ সালের মে মাসেও একই গড় ছিল। গত বছরও মে মাসের গড় তাপমাত্রা ছিল ৩২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই তুলনায় চলতি বছরের মে মাসের তাপমাত্রা গড়ের থেকে বেশি। গত সপ্তাহে একদিন প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে ফেলে।. জলপাইগুড়ির কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের রেকর্ড অনুযায়ী, বছর তিনেক ধরে ১৯-২১ মে জলপাইগুড়ি শহর ও লাগোয়া এলাকার তাপমাত্রা ৩০-৩১ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করেছে। সেখানে চলতি বছরে তাপমাত্রা প্রায় পাঁচ ডিগ্রি। আবহাওয়া দফতরের সুত্রে জানানো হয়েছে, বাতাসে আর্দ্রতার হারও অত্যন্ত কম। বর্ষার মরসুমের আগে নিম্নচাপ তৈরি না হলে বৃষ্টিপাত হয় না। গত একসপ্তাহে পেটের রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত দেড়শো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সিকিমের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের আধিকারিক গোপীনাথ রাহা বলেন, “উপগ্রহ থেকে যে ছবি ও তথ্য পাওয়া গিয়েছে তা অনুযায়ী হিমালয়ের পাদদেশে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেই বৃষ্টি বিক্ষিপ্ত এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যই চলবে।” তাই স্কুল খোলা থাকায় পড়ুয়াদের যে নানা সমস্যা হতে পারে সেই ব্যাপারে চিকিৎসকদের অনেকেরই সংশয় নেই। জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের চিকিৎসক পান্থ দাশগুপ্ত বলেন, “এবারের গরমে পেটের রোগের প্রকোপ বেশি বেড়েছে। ক্লান্তি, মাথা ব্যাথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গরমে তাপমাত্রার পরিববর্তনের ফলে বুকে সংক্রমণের প্রবণতাও রয়েছে। গরমে বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে হলে প্রচুর পরিমাণ জল দফায় দফায় খাওয়া জরুরি।” |