|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
ইউরোপের সাধারণ মানুষ কী চাইছেন |
ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যয়সঙ্কোচে তাঁদের পাইকারি আপত্তি নেই, কিন্তু সেই
কৃচ্ছ্রসাধন
যেন আয়বৃদ্ধির পথ রোধ না করে। এই দাবির গুরুত্ব রাষ্ট্রনেতাদের বুঝতে হবে। লিখছেন
তপন ভৌমিক |
ইউরো-র ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে ইউরো-গোষ্ঠীর সদস্য দেশগুলিতে আবার গভীর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গ্রিস এবং ফ্রান্সে নির্বাচনের পরে এ বার অনিশ্চয়তার মেঘ আরও জমাট, আরও ভয়ঙ্কর। রাজস্ব বাড়িয়ে এবং সরকারি ব্যয় কমিয়ে রাজকোষ নীতিতে স্থিরতা আনার জন্য মার্কিল-সারকোজির যুগলবন্দিতে একটি চুক্তিপত্র তৈরি হয়েছিল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তা অনুমোদন করেছিল। কিন্তু আপাতত সে চুক্তি রাজনৈতিক ঝড়ে উড়ে গেছে। ইউরোপের মানুষ ব্যয়সঙ্কোচের সম্পূর্ণ বিরোধী নন, কিন্তু যে নির্মম ব্যয়সঙ্কোচ তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তাঁরা সেটা মেনে নিতে নারাজ। গ্রিসের নির্বাচনে কোনও দল বা জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারে-কাছে পৌঁছতে পারেনি, ফলে সামনের মাসের মাঝামাঝি দেশে আবার নির্বাচন হবে। গ্রিস ইউরো ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, এই আশঙ্কা বেড়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও তেমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। গ্রিস ইউরো ছেড়ে গেলে পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং ইতালির ওপর তার যে প্রভাব পড়বে, ই ইউ নেতারা সে ব্যাপারেও সচেতন।
ইতিমধ্যে জি-এইট গোষ্ঠীর রাষ্ট্রনেতারা গ্রিসকে সাহায্য করতে একযোগে সম্পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রিুতি দিয়েছেন, সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তব অর্থ যা-ই হোক না কেন। গ্রিস যাতে ইউরো ছেড়ে বেরিয়ে না যায়, সে জন্য একটা শেষ চেষ্টা হয়তো করা হবে। কিন্তু আসল কথা হল, শুধু ব্যয়সঙ্কোচ আর কৃচ্ছ্রসাধনের পথে ইউরো অঞ্চলের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ মিলবে না। জনসাধারণের মতামত এবং আবেগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেও চলবে না। গ্রিস ও ফ্রান্সের নির্বাচন এবং তার পরে জার্মানিতে একটি প্রাদেশিক নির্বাচনে এঞ্জেলা মার্কেল-এর দলের পরাজয় স্পষ্ট বলে দেয় কৃচ্ছ্রসাধনের যে নীতি আয়বৃদ্ধিতে বাধা দেবে, জনসাধারণ তা প্রত্যাখ্যান করছেন।
ইউরোপের অনেকগুলো দেশের মানুষ এখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত, ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে, সে বিষয়ে তাঁদের কোনও ধারণাই নেই। এবং তাঁরা বুঝতে পারছেন না, তাঁদের পক্ষে কারা ভাল সোশালিস্ট, দক্ষিণপন্থী, নাকি মধ্যপন্থীরা। গ্রিসের নির্বাচনী ফলাফল দেখে মনে হয়, তাঁরা চাইছেন সবাই একসঙ্গে কাজ করুক। মার্কেল-সারকোজিরা সাধারণ মানুষের মতামত বা চাহিদাকে কোনও পাত্তাই দেননি। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন যে, অর্থনীতির সঙ্গে জনসাধারণের কোনও সম্পর্কই নেই। সেটাই আসল ভুল। আশা করব, গ্রিস এবং ফ্রান্সের নির্বাচনের পরিণাম দেখে ইউরোপের অন্য নেতারাও প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেবেন। |
|
‘আমাদের টাকা ফেরত দাও।’ প্রতিবাদ, আথেন্স, ১৮ মে, ২০১২। ছবি: রয়টার্স |
সরকারি ঋণের বোঝা যে ভাবে বেড়েছে, সেটা সত্যিই ভয়ের কারণ, সামাল দেওয়ার জন্য ব্যয়সঙ্কোচও জরুরি, কিন্তু তার কোপটা এসে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে, বিশেষত যাঁদের আর্থিক অবস্থা খারাপ। যেমন, বয়স্ক পেনশনভোগীরা যদি পেনশন না পান, তাঁদের দুর্দশার শেষ থাকবে না, এমনকী অনাহারের শিকার হতে পারেন তাঁরা। গ্রিকদের যে ধরনের চরম ব্যয়সঙ্কোচ করতে বলা হয়েছে, সেটা কেবল অত্যন্ত কঠোর নয়, অপমানজনকও বটে। কিন্তু এই ভাবে কৃচ্ছ্রসাধন করলেই যে সরকারি ঋণের সঙ্কট কাটবে এবং আয়বৃদ্ধির হার ভাল হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনি। মার্কেল-সারকোজি বিস্তর চিন্তাভাবনা করে আর্থিক স্থিতি আনার জন্য যে ব্যবস্থাপত্রটি তৈরি করেছেন, তাতে মানবিকতার কোনও চিহ্নমাত্র নেই।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতারা এখনও একটা কথা বুঝতে পারছেন না। সরকারি ঋণের গোটা সমস্যাটার পিছনে একটাই মূল কারণ ছিল এবং আছে। দেশগুলির উৎপাদন এবং আয় বাড়ছে না, বেকারত্ব বিপুল, এই সঙ্কট তারই পরিণাম। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের, বিশেষ করে ইউরো অঞ্চলের দেশগুলিতে (যেখানে ‘ইউরো’ই মুদ্রা হিসেবে চলে) আয়বৃদ্ধির গতিভঙ্গ হয়েছে অনেক দিন আগেই। বিশেষত, একটি অভিন্ন বাজার এবং অভিন্ন মুদ্রা চালু করে আয়বৃদ্ধির গতি ফেরানো যায়নি, কারণ ইউরো-গোষ্ঠীর সদস্য দেশগুলির অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সামর্থ্য কমেছে। সরকারি ঋণ জমে ওঠার এটাই অন্যতম প্রধান কারণ। এই পরিপ্রেক্ষিতটি মনে রাখলে বোঝা যাবে যে, শুধু কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি অনুসরণ করলে ইউরোপের বিপন্ন দেশগুলি একটা দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় আক্রান্ত হবে এবং আয়বৃদ্ধির বদলে আয় কমে যাবে। সুতরাং ইউরোপীয় রাষ্ট্রনেতাদের আয়বৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগী হওয়া নিতান্ত জরুরি। নিছক স্থিতির জন্য চুক্তি না করে, আয়বৃদ্ধির জন্যও চুক্তি করা জরুরি। তার মানে এই নয় যে, কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজন নেই, কিন্তু আয়বৃদ্ধির চেষ্টা না করে অতিমাত্রায় ব্যয়সঙ্কোচ করলে বিপর্যয় ঘটবে। এক দিকে কৃচ্ছ্রসাধন এবং অন্য দিকে আয়বৃদ্ধিতে উৎসাহ দান এই দুইয়ের একটা যথাযথ সমন্বয় চাই।
কথাটা বলা সহজ, করা অনেক কঠিন। সমন্বয় ঠিক কেমন হবে, সেটাই প্রশ্ন। প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হল, বিপুল ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ইউরোপের দুর্বল দেশগুলি আয়বৃদ্ধির হার বাড়াতে আদৌ সক্ষম হবে কি? তা ছাড়া, ইউরোপীয় ব্যাঙ্কগুলিকে আসন্ন বিপর্যয় থেকে বাঁচানোও এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর ফলে আয়বৃদ্ধির পথে প্রত্যাবর্তন আরও কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ ব্যাঙ্কের হাল ফেরানোর জন্য যা করা হয় তাতে আয়বৃদ্ধির গতিতে আরও কমে আসে। এ ক্ষেত্রে স্পেনের অবস্থা বিশেষ ভাবে উদ্বেগজনক। আশঙ্কা হয় যে, সরকারি ঋণের বোঝা লাঘবের জন্য কৃচ্ছ্রসাধন, কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে আয়বৃদ্ধির গতিভঙ্গ, আয় কমে যাওয়ার ফলে আরও ঋণ এই ভাবে একটা দুষ্টচক্র তৈরি হতে পারে, যার পরিণামে ব্যাঙ্ক তথা বিত্তব্যবস্থার সর্বনাশ ঘটবে।
এই জটিল এবং গভীর সমস্যার মোকাবিলা কোথা থেকে শুরু করা দরকার? কৃচ্ছ্রসাধন এবং আয়বৃদ্ধিতে উৎসাহদান, দুটো একসঙ্গে করা সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে কোনটি দিয়ে শুরু করা ভাল? আমি মনে করি, রাজকোষ নীতির সংস্কারে ইউরো নেতাদের কিছুটা নমনীয় থাকা জরুরি, অর্থাৎ অবস্থা বুঝে কৃচ্ছ্রসাধনের মাত্রা ঠিক করা উচিত। রাজকোষ ঘাটতিকে জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে ইউরো অঞ্চলের সদস্য দেশগুলির ওপর এই যে শর্তটি আরোপিত হয়েছে, আপাতত সেটিকে কিছুটা শিথিল রাখা ভাল, যাতে প্রয়োজনে ঘাটতি আর একটু বেশি রাখা যায়। সে জন্য ম্যাসট্রিখ্ট চুক্তিতে উপযুক্ত সংশোধন ঘটানো দরকার অথবা এই চুক্তি সাময়িক ভাবে মুলতুবি রাখা দরকার, যাতে বিভিন্ন দেশের সরকার নিজের নিজের ঘাটতির মাত্রা স্থির করতে পারে। দুর্বল দেশগুলিকে নীতি নির্ধারণের এই স্বাধীনতা দেওয়া হলে তাদের পক্ষে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর মতো জরুরি ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় করা সহজ হবে, যে ব্যয়ের ফলে আয়বৃদ্ধি উৎসাহিত হতে পারে।
ব্যয়সঙ্কোচ বা কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নানা ক্ষেত্রে নানা ভাবে চালু করা সম্ভব। একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল শ্রমের বাজার। এই সত্য স্বীকার করা দরকার যে, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে ইউরোপের সামর্থ্য খুব সীমিত। দুই জার্মানি এক হওয়ার পরে সে দেশে শ্রমের বাজারে নানা প্রয়োজনীয় সংস্কার ঘটানো হয়েছিল, যার ফলে এই সমস্যা অনেকাংশে মিটে গিয়েছিল, জার্মানি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বাজারে সামর্থ্য ফিরে পেয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা থেকে ইউরোপের দুর্বল দেশগুলির শিক্ষা নেওয়ার আছে। একই সঙ্গে যে সব সরকারি ব্যয় অপ্রয়োজনীয় এবং যার উৎপাদনশীলতা কম, সেগুলি কাটছাঁট করা আবশ্যক। তার ফলে যদি কিছু মানুষ বেকার হন, সেটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু ইউরো অঞ্চলের প্রত্যেকটি দেশেই সরকারি ব্যয়ের কাঠামো পুনর্বিন্যাসের অনেক সুযোগ আছে। আমি বলতে চাইছি, ব্যয়সঙ্কোচ নিশ্চয়ই করতে হবে, কিন্তু দুটি কথা মাথায় রেখে এক, খরচ কমাতে গিয়ে আয়বৃদ্ধির পথ যেন বন্ধ হয়ে না যায় এবং দুই, ব্যয়সঙ্কোচের কর্মসূচি যেন সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়।
গ্রিসের নির্বাচনী ফলাফলের দিকে তাকালে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যায়। মানুষ কৃচ্ছ্রসাধনের সম্পূর্ণ বিরোধী নয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ যদি অনিশ্চিত হয়, তা হলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তখন অর্থনৈতিক সমস্যা মেনে নিতে তাদের প্রবল আপত্তি দেখা দেয়। ফ্রান্সেও সোশালিস্ট দলের ফ্রঁসোয়া ওলাঁদ জয়ী হয়েছেন অল্প ভোটের ব্যবধানে, তাতে বোঝা যায়, সারকোজির আর্থিক শৃঙ্খলার নীতি এবং কর্মসূচিকে সে দেশের মানুষ পাইকারি ভাবে প্রত্যাখ্যান করেননি। কিন্তু গোটা পরিস্থিতিটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে একটা সত্য বুঝতে অসুবিধা হয় না বর্তমান সঙ্কট থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ কী, সে বিষয়ে ভোটদাতারা সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত বোধ করছেন। ব্রাসেলস-এর সদর দফতরে বসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের এই সত্যটি বুঝতে হবে এবং সেই অনুসারে নিজেদের নীতি ও অবস্থানকে অনেক নমনীয় করতে হবে। কৃচ্ছ্রসাধন এবং আয়বৃদ্ধি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী এই দুই লক্ষ্য পূরণের পথ খোঁজাই এখন তাঁদের কাজ।
|
দিল্লিতে একটি বেসরকারি সংগঠনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। মতামত ব্যক্তিগত |
|
|
|
|
|