|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
গণতন্ত্রের স্বার্থে |
ভারতের উপরাষ্ট্রপতি এবং সেই সূত্রে রাজ্যসভার সভাপতি হামিদ আনসারি চাহেন, সংসদে বিভিন্ন বিল পর্যালোচনার জন্য যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠিত হয়, সেগুলির কাজকর্ম টেলিভিশন মারফত সম্প্রচারিত হউক। কারণ, তাঁহার মতে, এই কমিটিগুলি জরুরি জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় লইয়া অত্যন্ত গুরুতর ও উচ্চাঙ্গের আলোচনা চালাইয়া থাকে, সংসদের প্রাত্যহিক দিবসরজনীতে যাহার দেখা মেলে না। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে জানেন, সংসদে বিতর্ক ও আলোচনার মান কত নিম্ন। দিনের-পর-দিন রাজ্যসভায় পৌরোহিত্য করার তিক্ত অভিজ্ঞতায় তিনি দেখিয়াছেন, চিৎকার-চেঁচামেচি করিয়া সভা ভণ্ডুল করাই সাংসদদের অন্যতম প্রধান কাজ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াইয়াছে যে, অধিবেশন শুরুর পর প্রথম ঘণ্টাটি যে প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য ধার্য থাকে, তাহাতে চার-পাঁচটির বেশি প্রশ্ন কখনওই আলোচিত হইতে পারে না। তুলনায় সংসদীয় কমিটিগুলি অনেক স্থির চিত্তে দরকারি কাজ নীরবে সমাধা করে।
উপরাষ্ট্রপতি তাঁহার বক্তব্যের সমর্থনে পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনুসৃত অনুরূপ অনুশীলনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলি তাহাদের কাছে পাঠানো বিভিন্ন বিল বিশদে পর্যালোচনা করিয়া প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে। এই মুহূর্তে যেমন লোকপাল বিল, জমি অধিগ্রহণ বিলের মতো জরুরি ও বিতর্কিত বিলগুলি কমিটি পর্যালোচনা করিতেছে। পর্যালোচনার সময় সাংসদরা প্রায়শ তাঁহাদের দলীয় লাইনের সংকীর্ণ পথনির্দেশের ঊর্ধ্বে উঠিয়া মতামত দিয়া থাকেন, প্রকাশ্যে যে-অবস্থান লইতে তাঁহারা দ্বিধা বোধ করেন। তাই টেলিভিশন মারফত স্থায়ী কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্প্রচারের প্রস্তাবটির তাঁহারা বিরোধী। তাঁহাদের আশঙ্কা, ইহার ফলে দলীয় নীতির অনমনীয় বিশুদ্ধতা রক্ষার দায় হইতে তাঁহাদের বিচ্যুতির বিষয়টি জনসমক্ষে আসিয়া পড়িবে। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্নে দলীয় নীতি যে প্রায়শই জনস্বার্থের পরিপোষক নয়, বরং পরিপন্থী (যেমন খুচরা বিপণনে বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা), সংসদীয় কমিটির সভায় সে সম্পর্কে ইতিবাচক অবস্থান লইতে পারিলেও অন্যান্য প্রকাশ্য মঞ্চে সাংসদরা কখনওই তাহা করিবার ঝুঁকি লইতে প্রস্তুত নন। অথচ তাঁহারা এই ঝুঁকি লইলে জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাঁহাদের গ্রহণযোগ্যতাই আরও বৃদ্ধি পাইত।
উপরাষ্ট্রপতির প্রস্তাবের যাঁহারা বিরোধিতা করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে কংগ্রেসের মণিশঙ্কর আইয়ার আছেন। তাঁহার আপত্তির কারণ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাগুলি প্রায়শ ‘কোরাম’ অর্থাৎ ন্যূনতম সংখ্যক সাংসদের হাজিরার অভাবে অনুষ্ঠিতই হইতে পারে না। যদি বা সাংসদরা হাজির হন, কোনও মতে হাজিরার অভিজ্ঞানস্বরূপ স্বাক্ষরটি করিয়াই অন্যত্র চলিয়া যান। এই অবস্থায় কমিটির কাজকর্মের সম্প্রচার কী রূপে হইবে? কিন্তু এই অনুপস্থিত সদস্যদের অস্বস্তিতে ফেলার জন্যও তো এ ধরনের সম্প্রচার দরকারি। জনপ্রতিনিধিত্বের দায় নিষ্ঠার সহিত পালন না-করিবার মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি যে অবজ্ঞা বা ঔদাসীন্য নিহিত থাকে, তাহাও উন্মোচিত হওয়া দরকার। সংসদের বিভিন্ন কাজকর্মে সাংসদদের অংশগ্রহণ যদি দায়সারা, গতানুগতিক, অনিচ্ছাতাড়িত হয়, তবে তাঁহাদের যাঁহারা ভোট দিয়া সংসদে প্রেরণ করিয়াছেন, সেই নির্বাচকমণ্ডলীরও সে কথা জানা উচিত। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান যেমন প্রশ্নোত্তর পর্ব কাটছাঁট না-করিবার পক্ষে। তাঁহার মতে, অধিবেশনে এই অংশটিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গণ্য হওয়া উচিত। এই পর্বেই জনস্বার্থ বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে সাংসদদের প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জবাব দিতে মন্ত্রীরা বাধ্য থাকেন। দায়িত্বজ্ঞানহীন দলীয় সাংসদদের অন্তর্ঘাতে জরুরি এই পর্বটি প্রায়শই ভণ্ডুল হইতেছে, যাহা গণতান্ত্রিক বিতর্ক, আলোচনা ও জবাবদিহি চাহিবার অধিকার হইতে নির্বাচকমণ্ডলীকে বঞ্চিত করিবারই শামিল। সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বটিকেও তাই কোনও ক্রমেই খর্ব করা চলিবে না। |
|
|
|
|
|