প্রবন্ধ ২...
খ্যাতির শিখরেও তিনি ছিলেন বিদ্রোহের অধিকার রক্ষায় অবিচল
ত মঙ্গলবার যাঁর টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বিশ্ববাসী প্রথম কার্লোস ফুয়েন্তেস-এর প্রয়াণের সমাচার পান, তিনি আর কেউ নন, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ফিলিপ ক্যালডেরন। দেশ ও জাতির হয়ে প্রেসিডেন্ট যখন এ ভাবে ফুয়েন্তেস-এর উপর মেক্সিকোর দাবি প্রতিষ্ঠায় উদ্যত হন, তখন দুটি সমস্যার উদ্ভব হয়। এক, প্রেসিডেন্ট তাঁর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় নিরাপত্তার এমন কড়াকড়ি সৃষ্টি হয় যে, ফুয়েন্তেসের অনুরাগী পাঠকরা মনে করেন, রাষ্ট্র জনতার কাছ থেকে তাদের আদরের লেখককে ছিনতাই করে নিচ্ছে, যে-লেখক আজীবন রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থাকে সমালোচনা করে এসেছেন। দুই, ফুয়েন্তেস যে কেবল মেক্সিকোর নন, সমগ্র লাতিন আমেরিকার, (কলম্বিয়া, মেক্সিকো, চিলি, কিউবা বা আর্জেন্তিনার সাহিত্যকে লাতিন আমেরিকান মহাদেশীয় সাহিত্যের আকাশে উত্তীর্ণ করায় ফুয়েন্তেসের ভূমিকা ছিল অগ্রণীর) তাঁর সাহিত্যের সেই পরিব্যাপ্ত ঐতিহাসিকতাও এই রাষ্ট্রীয় শোকপালনের তাড়নায় খারিজ হয়ে যেতে পারে।
১১ নভেম্বর ১৯২৮ — ১৫ মে ২০১২
তাঁর সুহৃদ এবং সম্প্রতি নোবেল পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিক মারিয়ো ভার্গাস ইয়োসা যখন বলেন, ‘মেক্সিকোর ইতিহাসে তাঁর পা আমূল প্রোথিত থাকলেও ভূয়োদর্শী ফুয়েন্তেস জাতীয়তার সংকীর্ণ ভূগোল অতিক্রম করে সারা বিশ্বের রাজনীতি ও সংস্কৃতির ব্যাপ্ত আন্তর্জাতিকতার মহড়া নিতে পারতেন’, তখন এই মহান সাহিত্যিকের সর্বজনীনতা ও দেশকালোত্তীর্ণ মহিমার কিছু আভাস পাওয়া যায়। ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক হিসাবে তাঁর অসংখ্য রচনায় অবশ্যই মেক্সিকোর ইতিহাস ও সমাজ, বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব, দৈন্য ও সমৃদ্ধি ঘুরেফিরে এসেছে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য মোস্ট ট্র্যান্সপারেন্ট রিজিয়ন’-এ মেক্সিকো সিটিই মূল চরিত্র ছিল, যে চিৎকার করে ফুয়েন্তেসের সাহিত্যে রচিত হওয়ার দাবি জানাচ্ছিল, যেন বলছিলআমাকে নিয়ে লেখো, কেউ আমাকে নিয়ে কিছু লিখছে না কেন? অথচ অর্ধশতাব্দী পরে তাঁর শববাহী শকট সেই শহরের ভিড় ঠেলে এগোতে পারল না। এত যে মেক্সিকো-অন্ত প্রাণ, সেই ফুয়েন্তেসই কিন্তু গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ উপন্যাসটি সম্পূর্ণ লিখিত হওয়ার আগেই তার প্রথম তিনটি অধ্যায় বন্ধুদের মধ্যে বিলি করে এবং স্পেন ও ইউরোপে সেগুলি প্রকাশ করে তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। কিউবার মিগুয়েল আস্তুরিয়াস ও আলেহো কার্পেন্তিয়ের, আর্জেন্তিনার বরহেস এবং হুলিয়ো কোর্তাসার, চিলির হোসে দনোসো, কলম্বিয়ার গার্সিয়া মার্কেস, পেরুর মারিয়ো ভার্গাস ইয়োসা এবং মেক্সিকোর কার্লোস ফুয়েন্তেস মিলে জাদু-বাস্তবতার যে ঘরানা তৈরি করেন, বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারকে সংহত করেই তা বিকশিত হয়। এক দিকে সেরভান্তেস-এর দন কিহোতের মায়াবী স্বপ্নবদ্ধতার ভুবন, অন্য দিকে জেমস জয়েসের ইউলিসিস-এ অনুসৃত ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’ ঘরানার আপাত অসংবদ্ধ চেতনাস্রোত হয়ে ওঠে বিংশ শতাব্দীতে লাতিন আমেরিকার সামাজিক বাস্তবতার আলেখ্য নির্মাণের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য প্রকরণ। আর ফুয়েন্তেস হয়ে ওঠেন সেই আন্দোলনের সচেতন কাণ্ডারি। তাঁর ‘ডেথ অব আর্টেমিয়ো ক্রুস’ উপন্যাসে ওই চেতনাস্রোত শৈলী চমকপ্রদ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তোলে এক প্রাক্তন বিপ্লবীর মোহভঙ্গের বেদনা, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে যিনি ১৯১০-২০-র মেক্সিকো বিপ্লবের অগ্নিক্ষরা দিনের স্মৃতিচারণ করতে-করতে প্রত্যক্ষ করেন সহযোগী ও অনুগামীদের আদর্শচ্যুতি। অনেকেই ‘তেরা নস্ত্রা’-কে ফুয়েন্তেসের সবচেয়ে মহৎ সৃষ্টি বলে গণ্য করেন। এই বিশাল মহাকাব্যিক মাত্রার উপন্যাসে হিস্পানি সভ্যতার সমগ্র ইতিবৃত্ত বিধৃত করার চেষ্টা রয়েছে। ষোড়শ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী, রোমান সাম্রাজ্য থেকে দ্বিতীয় ফিলিপের শাসনকাল, অ্যাজটেক-ইনকা-মায়া ভূমিতে স্পেনীয় ‘কন্কিস্তাদর’দের নৃশংস উপনিবেশবাদ ও বিজয়-অভিযান, ভূমিজ অ্যাজটেক সভ্যতার বিলুপ্তি ও স্পেনীয় জয়যাত্রায় তার সাংস্কৃতিক প্রত্যাঘাত জেমস জয়েসের ‘ফিনেগানস ওয়েক’-এর আদলে তারই এক বাইজান্টিনীয় আলেখ্য রচনা করেছেন ফুয়েন্তেস।
পানামা শহরে জন্মানো ফুয়েন্তেসের শৈশব কেটেছে রাষ্ট্রদূত পিতার দৌলতে সান্টিয়াগো এবং ওয়াশিংটনে। অর্থনৈতিক মন্দার আমেরিকায় গাড়িতে যেতে যেতে রাস্তার ধারের রেস্তোরাঁয় ‘কুত্তা এবং মেক্সিকানদের প্রবেশ নিষেধ’ হোর্ডিং দেখার স্মৃতি তাঁর মধ্যে মেক্সিকান হওয়ার অহমিকা সঞ্চিত করে রাখে। স্বৈরাচারী পিনোশে-র সঙ্গে বর্হেসের সাক্ষাৎকার তিনি মেনে নিতে পারেন না। ফিদেল কাস্ত্রোকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে মার্কিন মুলুকে ‘অবাঞ্ছিত’ হয়ে যান। আবার মেক্সিকোর ছাত্র-আন্দোলনে জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ কূটনীতিকের সঙ্গ পরিহার করতে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূতের চাকরিতে ইস্তফা দেন। আন্দোলন দমনে সরকারের তীব্র সমালোচনা করে তাঁকে দেশত্যাগী হয়ে ইউরোপে নির্বাসনেও যেতে হয়। নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা বিপ্লবীদের সমর্থন জানানোর ফলে স্বদেশীয় কবি অক্তাভিয়ো পাস-এর সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য ঘটে যায়। তবু গণতন্ত্র ও বিদ্রোহের অধিকার নিয়ে নিজের অবস্থানে অবিচল থেকেছেন তিনি। তাঁকে বিভিন্ন সময়ে কমিউনিস্ট, অশ্লীল, খ্রিস্ট-বিরোধী, জার্মান-বিরোধী, ইহুদি-ঘেঁষা ইত্যাদি রকমারি নেতিবাচক তক্মা সেঁটে একঘরে করার চেষ্টা হয়েছে। তবু হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, কলম্বিয়া, ব্রাউন ও পেনসিলভেনিয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে বার বার সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশ্লেষণী অধ্যাপনায় তাঁর ডাক পড়েছে। সেখানে মার্কিন বিদেশ নীতির চুটিয়ে সমালোচনার সুযোগও তিনি হাতছাড়া করেননি।
সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার তাঁর অধরা থেকে গেছে। তবে তাতে তাঁর মহিমা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না। ফুয়েন্তেস সম্পর্কে তাঁর দেশবাসী সকলেই অবশ্য খুব উচ্ছ্বসিত নন। তাঁর সমালোচকরা মনে করেন, ফুয়েন্তেসের ঘোষিত মার্ক্সীয় জীবনাদর্শ এবং বাস্তবে আচরিত ভোগবাদী দিনযাপন মেলানো যায় না। জীবনবাদী ফুয়েন্তেস চুটিয়ে জীবন যাপন করেছেন, সমাজ ও সংস্কৃতির অভিজাত ও সম্ভ্রান্তদের সংসর্গ করেছেন, উচ্চ কোটির অন্দরমহলে অবাধে যাতায়াত করেছেন, মেক্সিকান অভিনেত্রী রিতা মাচাদো ও সাংবাদিক সিলভিয়া লেমুসকে বিয়ে করে সংসার করার বাইরেও ফরাসি অভিনেত্রী জাঁ মরো এবং মার্কিন অভিনেত্রী জিন সেবার্গ-এর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ফুয়েন্তেস মেক্সিকোকে উত্তর আমেরিকা ও কানাডার কাছে ‘বিক্রি’ করেছেন, বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসাবে মেক্সিকোর ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজকে সাজিয়ে পেশ করেছেন। বিদেশি পাঠকদের কাছে আবেদনের কথা ভেবে তিনি তাঁর সাহিত্যে মেক্সিকোর এক অতিরঞ্জিত, প্রায় পরাবাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে দেশের সরকারের সঙ্গেও অনেক বিষয়েই তাঁকে আপস করতে দেখা গেছে, যে জন্য মৃত্যুর পর তাঁকে আত্মসাৎ করতে প্রেসিডেন্ট ক্যালডেরনেরও সুবিধা হয়ে যায়। দেশের এই অতিরঞ্জিত পাশ্চাত্যরম্য চিত্রকল্প তুলে ধরার জন্য মেক্সিকোর আর এক দিকপাল সাহিত্যিক নোবেলজয়ী অক্তাভিয়ো পাস-এর সঙ্গে মনান্তরের কথাও প্রসঙ্গত আলোচিত হচ্ছে।
আর তাই তাঁর চিতাভস্ম শেষ পর্যন্ত প্যারিসের সেই কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হবে কি না, যেখানে জঁ পল সার্ত্র, স্যামুয়েল বেকেট, হুলিয়ো কোর্তাসার কিংবা সেসার ভায়েহো’র ভস্মাধারও সযত্নে রক্ষিত, তা নিয়েও এই শেষ বেলায় সংশয় দেখা দিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.