কালো টাকার প্রশ্নে নজরে জমি-সম্পত্তি ও সোনার ব্যবসা
প্রণবের শ্বেতপত্রকে ‘বিকিনি’ বললেন যশোবন্ত
দুর্নীতি ও কালো টাকার বিরুদ্ধে মনমোহন সরকার কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না, বিরোধীদের এই আক্রমণের জবাবে আজ সংসদে শ্বেতপত্র প্রকাশ করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। কালো টাকা নিয়ে এই শ্বেতপত্রে দোষীদের জন্য কড়া শাস্তির সুপারিশ করার পাশাপাশি কালো টাকা রুখতে রিয়েল এস্টেট ও স্বর্ণশিল্প-সহ বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে আরও বেশি নজরদারির কথাও বলেছেন প্রণব।
কালো টাকার প্রশ্নেই মনমোহন সরকারের বিরদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে গত বছর চল্লিশ দিনের রথযাত্রায় বেরিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। তাঁর অন্যতম দাবি ছিল, বিদেশি ব্যাঙ্কে কাদের কালো টাকা রয়েছে, সেই নামের তালিকা ঘোষণা করতে হবে। সেই দাবি অবশ্য পূরণ করা হয়নি শ্বেতপত্রে। বিদেশি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকার পরিমাণ কত, সে বিষয়েও নির্দিষ্ট কোনও তথ্য জানানো হয়নি। বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংহ তাই এই শ্বেতপত্রকে ‘বিকিনি’-র সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “এই শ্বেতপত্র প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিই আড়ালে রেখে দিয়েছে। আর বিকিনির মতো সেই সব প্রকাশ্যে এনেছে, যা দেখানোর কোনও প্রয়োজন নেই।” বিজেপির অভিযোগ, টুজি দুর্নীতির টাকা কোথায় গেল, তারও হদিস দিতে পারছে না সরকার। আডবাণী পুরো শ্বেতপত্রটিই ‘হতাশাজনক’ আখ্যা দিয়ে খারিজ করে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “সরকার ভাবমূর্তি স্বচ্ছ করার ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার একটা সুযোগ পেয়েছিল। সেই সুযোগটা হারাল আজ।”
অর্থ মন্ত্রকের পাল্টা যুক্তি, কালো টাকার পরিমাণ মাপার কোনও নিখুঁত মাপকাঠি কারও কাছেই নেই। তাই এক-এক ক্ষেত্রে এক-এক রকম হিসেব উঠে আসে। সরকারের মূল লক্ষ্য হল, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা চিহ্নিত করে তা দেশে ফিরিয়ে আনা এবং কর আদায় করা। এ জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। এবং সেই চুক্তি মোতাবেক দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কারও নাম প্রকাশ সম্ভব নয়। তবে সরকার যে হাত গুটিয়ে বসে নেই, ৯৭ পাতার শ্বেতপত্রে বারবার সে কথাই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন প্রণব।
শ্বেতপত্রে জানানো হয়েছে, সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমেছে। এ দেশে ‘কালো টাকার সিন্দুক’ বলে পরিচিত সুইস ব্যাঙ্কে ২০০৬ সালে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ২০১০-এ তা নেমে এসেছে ৯ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। কমেছে অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থের অনুপাতও। যদিও বিজেপি-র প্রশ্ন, সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত টাকা কমেছে ১৪ হাজার কোটি। কিন্তু কোথায় গেল সেই টাকা? তা কি ভারতেই ফিরে এসেছে, নাকি মরিশাস, কেম্যান আইল্যান্ডস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড বা লুক্সেমবুর্গের মতো অন্য কোনও দেশে জমা হয়েছে, যেখানে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে? শ্বেতপত্র নিয়ে সরকারকে তুলোধোনা করলেও বিজেপি নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করেছে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে। কারণ, ২০০৬ সাল থেকেই বিজেপি কালো টাকা নিয়ে সরব রয়েছে।
বিজেপি এ বার কালো টাকার প্রশ্নে কী করবে, সেটাই প্রশ্ন। কালো টাকা নিয়ে দাবিদাওয়াকে পুঁজি করেই রথযাত্রা ও তার পরে শীতকালীন অধিবেশন মুলতুবির প্রস্তাব এনেছিল বিজেপি। সেই মুলতুবি প্রস্তাবের মতোই আডবাণীর মূল দাবিগুলি খারিজ করা হয়েছে শ্বেতপত্রে। এর পর আডবাণী ফের রথযাত্রায় বেরোবেন কি না, তা নিয়েও অনেকে কৌতূহল প্রকাশ করেন এ দিন। বিজেপি নেতৃত্ব জানিয়েছেন, তাঁরা শ্বেতপত্রটি খতিয়ে দেখে পরবর্তী রণকৌশল স্থির করবেন।
শ্বেতপত্রে প্রণববাবু ঘোষণা করেছেন, বিনিয়োগকারী বা কর্পোরেট সংস্থাগুলির কর ফাঁকি বরদাস্ত করা হবে না। ভোডাফোনের সঙ্গে হাচিসনের ব্যবসায়িক লেনদেনের উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, ভারতে ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও কর ফাঁকি দিতেই ওই লেনদেন কেম্যান আইল্যান্ডসে করা হয়েছিল। যেখানে কর দিতে হয় না। অন্য দেশে লেনদেন হয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে ভারতেও কর মেটাতে অস্বীকার করে ভোডাফোন-হাচিসন। সুপ্রিম কোর্ট ভোডাফোনের পক্ষে রায় দিলেও তার বিরুদ্ধ অবস্থানই নিয়েছে সরকার। একই ভাবে রিয়েল এস্টেটের মতো ক্ষেত্রে কালো টাকার অনুপ্রবেশ রুখতেও সরকার কড়া হতে চাইছে বলে আজ ইঙ্গিত মিলেছে। এখন জিডিপি-র ১১ শতাংশ আসে এই জমিজমা-সম্পত্তির ব্যবসা থেকে। এই ক্ষেত্রে কালো টাকার লেনদেন রুখতে বিক্রির সময় উৎসেই কর কেটে নেওয়া বা টিডিএস চালু করতে চাইছে অর্থ মন্ত্রক। সোনার বার ও গয়না কেনাকাটির উপরে আরও বেশি নজরদারির সুপারিশ রয়েছে শ্বেতপত্রে। কেন্দ্র মনে করছে, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনে উৎসাহ দিতে কর ছাড় দেওয়া যেতে পারে।
বণিকসভা অ্যাসোচ্যাম সরকারের শ্বেতপত্রকে স্বাগতই জানিয়েছে। অ্যাসোচ্যামের পরামর্শ, এর আগে স্বেচ্ছায় কালো টাকা জমা করার প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। এতে কালো টাকা জমা দিলে তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হত না, বা শাস্তিও হত না। আবার তা চালু করার কথা ভেবে দেখতে পারে কেন্দ্র। যদিও সরকারের বক্তব্য, এমন প্রকল্প চালুর আগে নীতিগত বিষয়গুলি খতিয়ে দেখা জরুরি।
কালো টাকা রুখতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা রয়েছে শ্বেতপত্রে। এ পর্যন্ত কী কী করা হয়েছে, তার খতিয়ানের পাশাপাশি ভবিষ্যতে সরকার আরও কী কী করতে চায়, রয়েছে তার ফিরিস্তিও। যে সব বিদেশি সংস্থা এ দেশে বিনিয়োগ করছে, তাদের সমস্ত আন্তর্জাতিক লেনদেন সরকারকে জানাতে বাধ্য করা হবে। কেন্দ্রীয় স্তরে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আর্থিক অপরাধের মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট তৈরিরও সুপারিশ রয়েছে। কেন্দ্র মনে করছে, একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি প্রয়োজন। নিজে থেকেই কর মেটালে ছাড় দিয়ে আরও বেশি উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু করতে চায় কেন্দ্র। অর্থ মন্ত্রক মনে করছে, এ দেশের কালো টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আবার এ দেশে নাম নথিভুক্ত না করেই বিভিন্ন সংস্থা সেই টাকাই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছে। রিয়েল এস্টেট, আর্থিক ক্ষেত্র, সরকারি অধিগ্রহণ, অলাভজনক সংস্থা, বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো ক্ষেত্রে কালো টাকা আসার আশঙ্কা বেশি। তাই এই সব ক্ষেত্রে আরও বেশি সংস্কার প্রয়োজন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.