পুবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর দক্ষিণে জয়ললিতা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা আরও বাড়িয়ে দিলেন দেশের দুই প্রান্তের দুই নেত্রী।
ইউপিএ-র দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক দলের নেত্রী মমতা যেমন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, রাষ্ট্রপতি ভোটে প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর পছন্দের প্রার্থী নন। বরং তাঁর পছন্দের তিন প্রার্থী হলেন লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম। মমতার বক্তব্যে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়েছে কংগ্রেস। যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার পূর্ণ সাংমার নাম রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ককে সঙ্গে নিয়ে এ ব্যাপারে পুরোদস্তুর দৌত্যে নেমে পড়েছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি ভোটে কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলতে জয়া-নবীনের এই কৌশলে বিজেপি-ও তলে তলে সামিল বলে মনে করা হচ্ছে। বিজেপি সূত্রের খবর, জয়ললিতা ও নবীন দু’জনেই গত কাল ফোন করেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীকে। সাংমাকে খ্রিস্টান প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার জন্য তাঁদের পরামর্শ দেন আডবাণী। ইতিমধ্যে পূর্ণ সাংমাও সোমবার রাতে বলেছেন, “পিছু হটার প্রশ্নই নেই। জয়ললিতা ও নবীনের প্রচেষ্টা বিফলে যাক, আমি চাই না। প্রয়োজনে নির্দল প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি ভোটে লড়ব।”
রাষ্ট্রপতি ভোটের নোটিস জারি হবে জুনের প্রথমার্ধে। তার ক’দিন আগেও এই রাজনৈতিক ছবিই বলে দিচ্ছে, পরিস্থিতি কতটা জটিল। তার মধ্যেই মমতার মন্তব্য সবথেকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কেন্দ্রে শাসক জোটের তরফে একজন সর্বসম্মত প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য সনিয়া গাঁধী ইতিমধ্যেই প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন। কারও নাম প্রস্তাব না করলেও ইউপিএ-র তিন প্রধান শরিক দলের নেতা-নেত্রী মমতা, করুণানিধি এবং শরদ পওয়ারের সঙ্গে কথাও বলেছেন তিনি। ওই বৈঠকের পরে এখনও পর্যন্ত পওয়ার বা করুণানিধি তাঁদের পছন্দের প্রার্থী নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। কিন্তু পছন্দের প্রার্থী নিয়ে প্রথম মুখ খুলে মমতা যা বললেন, তাতে শাসক জোটের পক্ষে সর্বসম্মত প্রার্থী খোঁজার প্রক্রিয়া যথেষ্ট কঠিন হয়ে গেল বলেই মনে করা হচ্ছে।
শরিক নেতৃত্বের সঙ্গে কংগ্রেস সভানেত্রীর বৈঠকের পর থেকে রাষ্ট্রপতি ভোটে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন অনেকে। কিন্তু একটি ইংরেজি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “প্রণব বিশ্বের পুত্র হতে পারেন, কিন্তু আমার পছন্দ জানতে চাইলে বলব, মীরা কুমার, গোপালকৃষ্ণ গাঁধী এবং এ পি জে আব্দুল কালাম। অবশ্য কংগ্রেস যদি প্রণবকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করতে চায়, তা হলে সেটা তাদের ব্যাপার।” কেন ওই তিন জনের নাম তিনি প্রস্তাব করছেন, তার ব্যাখ্যা দিয়ে মমতা বলেন, “আমি মীরা কুমারকে ভালবাসি। তিনি মৃদুভাষী। গোপালকৃষ্ণ ভাল মানুষ আর কালাম একজন ভাল রাষ্ট্রপতি ছিলেন।”
কংগ্রেসের শীর্ষ সারির এক নেতার কথায়, “অনেকেরই ধারণা ছিল যে, বাঙালি ভাবাবেগের কারণে মমতা নিশ্চয়ই প্রণববাবুকে সমর্থন করবেন। কিন্তু সেই ধারণাটা মমতা আজ ভেঙে দিয়েছেন। বরং বাংলার ভূমিপুত্রকে ‘বিশ্বের পুত্র’ বলে আখ্যা দেওয়ার মধ্যে যথেষ্ট কটাক্ষ করা হয়েছে।”
রাজনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে, এমনিতেই কংগ্রেসের পক্ষে একজন সর্বসম্মত প্রার্থী বাছাই করা এ বার যথেষ্ট কঠিন। অঙ্কের হিসেবেই তাদের এমন প্রার্থী খুঁজতে হবে, যাঁকে ইউপিএ-র শরিকরা তো বটেই, সরকারের সমর্থক সপা-বসপা এবং আরজেডি-ও মেনে নেবে। কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “এমন নয় যে মমতা যে তিন জনের নাম প্রস্তাব করেছেন, তাঁদেরই মেনে নিতে হবে কংগ্রেসকে। কিন্তু এ-ও ঠিক, কংগ্রেস যে প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে, তাঁকে মমতার পছন্দের হতে হবে। মমতা নিজের পছন্দের কথা বলে দিয়ে সেই প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটা কংগ্রেসের পক্ষে আরও জটিল করে দিয়েছেন।”
কংগ্রেস নেতৃত্বের আর এক অংশের মতে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে মমতা আসলে রাজনৈতিক দর কষাকষি করছেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য, রাজ্যের জন্য মোরাটোরিয়াম আদায়। কাল সংসদের অধিবেশন শেষ হচ্ছে। তার আগেই সুর চড়ানোর কাজটা শুরু করে দিয়েছেন তিনি।
এর মধ্যেই আজ বৈঠকে বসে এনডিএ-র সংসদীয় দল। পরে বিজেপি-র এক শীর্ষ নেতা বলেন, “নবীন ও জয়ার তৎপরতায় বিজেপি-র কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ বিজেপি কারও নাম প্রস্তাব করলে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে রাজনীতি শুরু হয়ে যাবে।” ওই নেতার যুক্তি, জয়া-নবীনরা যদি কারও নাম তুলে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে এক ছাতার তলায় আনতে পারলে বিজেপি-র সমর্থন জানাতে অসুবিধা নেই। সে ক্ষেত্রে সাংমা যে হেতু শাসক জোটেরই এক নেতা এবং তাঁর মেয়ে আগাথা কেন্দ্রে মন্ত্রী, তাই কংগ্রেস আরও চাপে পড়বে। |