জেলা সম্পাদক হিসাবে নিজের ‘দক্ষতা’ প্রমাণের চেষ্টায় নেমেছেন সিপিএম নেতা গৌতম দেব।
এক বছর আগে বিধানসভার ভোট-প্রচারে তিনি দল এবং বামফ্রন্টে ছিলেন প্রথম সারিতে। এমনকী, ক্ষমতাচ্যুত হলেও বিধানসভায় তিনি বিরোধী দলনেতা হবেন, এমনটাই ভাবা হচ্ছিল। যদিও ভোটের প্রচারে ‘অতি-ব্যবহারে’ তাঁর স্টাইল কিছু সময় পর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। আলিমুদ্দিনের একাংশ মনে করে, নাগরিক ভোটারদের ‘বিমুখ’ হওয়ার পিছনে গৌতমবাবুর ‘অযথা আস্ফালন’ও ছিল। ভোট-রাজনীতিতে ‘আনকোরা’ ব্রাত্য বসুর কাছে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরে গৌতমবাবু খানিকটা অন্তরালে চলে যান। তারপর দলের ‘সঙ্কট সময়ে’ তাঁকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দায়িত্ব দেয় আলিমুদ্দিন। যে সুযোগে আপাতত দলের সঙ্গে নিজেকেও তুলে ধরতে ‘তৎপর’ গৌতমবাবু।
এক দিকে দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রকে দিয়ে জেলা জুড়ে সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গৌতমবাবু। অন্যদিকে, স্থানীয় স্তরের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, কমপক্ষে ১০ লক্ষ মানুষের কাছে সরাসরি যেতে হবে। সেই সঙ্গে এক মাসে দলের ত্রাণ তহবিলে তুলতে হবে ন্যূনতম দু’কোটি টাকা। যে অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হবে ঘরছাড়া নেতা-কর্মীদের সাহায্যার্থে।
অমিতাভ বসু-অমিতাভ নন্দীরা যে ভাবে গত ১০-১২ বছর ধরে জেলা পার্টিতে ‘ছড়ি ঘুরিয়েছেন’, তা বন্ধ করতেই বুদ্ধবাবুরা গৌতমবাবুকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সম্পাদক করেছেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য গৌতমবাবু দীর্ঘ দিন জেলা পার্টির দৈনন্দিন কাজে যুক্ত ছিলেন না। আচমকা ‘দায়িত্ব’ পেয়ে নেতৃত্বের প্রমাণ দিতে তিনি ‘মরিয়া’। তিনি এ-ও জানেন যে, দলের একাংশ তাঁকে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর ‘উত্তরসূরি’ বলে মনে করেন। ফলে তাঁর বাড়তি ‘তাগিদ’ রয়েছে নিজেকে প্রমাণের। ইতিমধ্যেই নিজের পছন্দমতো জেলা সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করেছেন তিনি। আপাতত শনি ও রবিবার দলের পলিটব্যুরোর সদস্যদের দিয়ে সীমান্তবর্তী বনগাঁ থেকে আরম্ভ করে মুসলিম প্রধান দেগঙ্গা, শ্রমিক-অধ্যুষিত শ্যামনগর, মধ্যবিত্তদের দমদমে সভা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। |
গৌতম-ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নেপালদেব ভট্টাচার্যের কথায়, “কর্মীদের মনোবল বাড়াতে, সংগঠনকে চাঙ্গা করতে, ঘরছাড়া-অত্যাচারিতদের জন্য ত্রাণ তহবিলে টাকা তুলতে এই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।” নেপালবাবুর কথায়, “বিধানসভা ভোটে পরাজয়ের পরে দলের নিচুতলার কর্মীদের একাংশের মনোবল ভেঙে গিয়েছে। তা চাঙ্গা করতে হবে।” দলে যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই তা বোঝাতে দমদমের সভায় বুদ্ধবাবু, গৌতমবাবুর পরে বক্তার তালিকায় তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে রাখা হয়েছে এই এলাকার প্রাক্তন সাংসদ অমিতাভ নন্দীকে! জেলা কমিটির এক নেতার কথায়, “প্রতিটি সভাতেই ভিড় দেখিয়ে গৌতমবাবু দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বার্তা দিতে চান, পরাজয়ের পরেও মানুষের একটা বড় অংশের সমর্থন আমাদের সঙ্গেই রয়েছে।”
বিধানসভা ভোটের পর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা থেকেও বেশি মানুষ ‘ঘরছাড়া’ হয়েছেন বর্ধমান ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেও ‘অত্যাচারিত’ সিপিএম কর্মীর সংখ্যা কম নয়। প্রতিটি জেলাতেই পার্টি কর্মীদের জন্য ত্রাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। বর্ধমান জেলায় দলের প্রত্যেক সদস্যকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, পার্টির এই দুর্দিনে তাঁদের অতিরিক্ত অর্থ সাহায্য করতে হবে। সেখানে ইতিমধ্যেই দু’কোটির বেশি চাঁদা তোলা হয়েছে। আরও টাকা উঠছে। কিন্তু নীরবে। ভোট-পরবর্তী সবচেয়ে বড় হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটেছে বর্ধমানে। খুন হয়েছেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা এবং দলের নেতা কমল গায়েন। জেলায় প্রায় চার হাজার মানুষ ঘরছাড়া। প্রায় ৬০০ নেতা-কর্মী জেলে। জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতার কথায়, “প্রতি মাসে মামলা চালাতেই খরচ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।” দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও নির্দেশ জারি করে দলীয় কর্মীদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই কোটি টাকা সংগৃহীত হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে কর্মীদের থেকে এত টাকা জোগাড় না-করা গেলেও নিচুতলায় প্রচার চালানো হয়েছে। সর্বত্রই
বড় সমাবেশের তুলনায় বেশি জোর দেওয়া হয়েছে ছোট সভার উপরে।
কিন্তু অন্য জেলা নেতৃত্ব যে কাজ নীরবে করছে, উত্তর ২৪ পরগনা তা করছে রীতিমত ঢাকঢোল পিটিয়ে। কেন? রাজ্য কমিটিরও এক সদস্যের কথায়, “ওই জেলার নেতৃত্ব কর্মীদের একটা ঝাঁকুনি দিতে চান। পাশাপাশি, দলের শীর্ষ নেতাদের দেখাতে চান, তাঁদের সঙ্গে মানুষ আছে।”
‘ঝাঁকুনি’ দিতে চান গৌতমবাবুও। এটা বোঝাতে যে, আলিমুদ্দিন তাঁকে ‘চাপিয়ে’ দিলেও বিরোধী গোষ্ঠীর ‘চাপ’ সামলানোর ক্ষমতা তিনি রাখেন। |