বুড়ো বাবা-মা একা। ছেলেমেয়ে থাকে দূরে। গল্পটা চেনা। জটিলও বটে। আবেগ স্বাভাবিক,
কিন্তু যুক্তিটাও বাদ দিলে চলবে না। রোজগেরে, দূরে থাকা সন্তান মানেই ‘ভিলেন’ নয়। লিখছেন
বিশ্বজিৎ রায় |
যে বঙ্গীয় পিতা-মাতা স্বীয় জাতিপাতের ভয়ে পুত্রকে শিক্ষার্থ ইংলণ্ডে যাইতে দেন না কৈকেয়ীর কার্য তদপেক্ষা যে শতগুণে অস্বার্থপর, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ভালোবাসার অত্যাচার)
ইদানীং খবরের কাগজে প্রায়ই চোখে পড়ে বৃদ্ধ বাবা-মা ছেলেমেয়েদের অনাদরের শিকার। যে ছেলেমেয়েদের তাঁরা তিলে তিলে বড় করে তুলেছেন এখন তারাই বাবা-মাকে দেখে না। অনেক সময় অপমানও করে। ফলে, অসহায় অভিমানী বাবা-মায়েরা জীবন শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবেন। সম্প্রতি সংবাদপত্রে পড়লাম, অনঙ্গ সরকার ও বেলা সরকার বৃন্দাবনে গিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। বেনাচিতি-কালনা রুটের বাসচালক অনঙ্গবাবু বুড়ো বয়সে তাঁর পাঁচ ছেলের ঔদাসীন্যে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। বৃন্দাবন যাওয়ার টাকা ছিল না বলে কালনায় মহিষমর্দিনী ঘাটে ঘুমের ওষুধ খেয়ে জলে ডুবে মরতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
২০০৩-এ রবি চোপরার হিন্দি ছবি বাগবান (বাগ অর্থাৎ বাগানের রূপকার )-এ অমিতাভ বচ্চন আর হেমা মালিনি বুড়ো বাবা-মায়ের ভূমিকায় ছিলেন। ‘হিট’ ছবিটির শেষে বুড়ো বাবা অমিতাভের দীর্ঘ ভাষণ ছিল। নব্য প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের স্বার্থপরতা আর নীতিহীনতাই সে ভাষণের বিষয়। শুনলে আবেগ সঞ্চারিত হয়। বাবা-মায়ের প্রতি হাল আমলের ছেলেমেয়েদের অবহেলার বৃত্তান্তে ছেলেমেয়েদের সচরাচর ভিলেন হিসেবেই দেখানো হয়। কিন্তু ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষিতে বিচার করলে বোঝা যায় বাবা-মা আর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের সম্পর্কের বৃত্তান্তটি একমাত্রিক নয়। ছেলেমেয়েরা সত্যিই অপরাধী হলে তাদের সমালোচনা করতে হবে, আইনের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু বাবা-মায়েরও যে কিছু দায়িত্ব থাকে তা ভুলে গেলে চলবে না।
|
নিঃসঙ্গ। কিন্তু, কেন? সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ ছবিতে ‘সর্বজয়া’-র চরিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
চিকিৎসাবিজ্ঞানের সৌজন্যে এখন গড় আয়ু আগের থেকে অনেক বেশি। অর্থনৈতিক পালাবদলের সূত্রে অধিকাংশ উপার্জনক্ষম সন্তানসন্ততি বাবা-মায়ের কাছে থাকেন না, দূরান্তে কাজের জায়গায় থাকেন। যৌথ পরিবারের পুরনো চেহারাও আর নেই। কাজেই বুড়ো বাবা-মায়ের একাকিত্ব অনিবার্য। এটা উচ্চবিত্ত ‘ইন্ডিয়ান’ এবং মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত ‘ভারতীয়’ পরিবার, উভয় তরফেই সত্য। সুতরাং প্রথমেই এ কথা মেনে নিতে হবে, ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল তখন বাবা-মা ছেলেমেয়েদের কাছে থাকতেন বলে বুড়ো বয়সে সব সময় ছেলেমেয়েকে বাবা-মায়ের কাছে কাছেই থাকতে হবে, এটা অসম দাবি।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকে এমন দাবিকে ‘ভালবাসার অত্যাচার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। উনিশ শতকে ভারতীয় সমাজ আধুনিক হচ্ছিল। পুরনো গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে গড়ে উঠছিল আধুনিক পারিবারিকতা। সেই পারিবারিকতার এক পক্ষে বাবা-মা অপর দিকে ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েদের মনে রাখতে হবে তাঁরা যা উপার্জন করেন তার একাংশের ওপর বাবা-মায়ের দাবি স্বাভাবিক। নিয়ম করে দেওয়া উচিত ছেলেমেয়েরা যা আয় করেন সেই আয় অনুপাতে বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রতি মাসে সম্মানসহ দিতে হবে। এ তো দান বা ভিক্ষা নয়, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন। বাবা মায়ের অবসরভাতা সব ক্ষেত্রে থাকে না, সে ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব আরও বেশি। যেমন অনঙ্গবাবু বাস চালাতেন, সরকারি চাকরি করতেন না। তাঁর পেনশন নেই। সুতরাং আইন থাকলে ও তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটলে উপার্জনক্ষম পাঁচ ছেলের উচিত ছিল আয় অনুপাতে বাবা-মাকে মাসে মাসে টাকা দেওয়া।
|
টাকা পয়সার বিষয়টি আইন করে মেটানো যায়। বুড়ো বয়সে সমস্যা তো শুধু অর্থের নয়, একাকিত্বেরও। এখনকার সামাজিক কাঠামো অনুসারে হাতের কাছে ছেলেমেয়ে থাকবে না। কাজেই ছেলেমেয়ে, জামাই-বউমা, নাতিনাতনি নিয়ে গোষ্ঠীসুখ ও গুষ্টিসুখ উপভোগের আশা না করাই ভাল। কিন্তু আমরা তো শুধু পারিবারিক জীব নই, সামাজিক জীব। পরিবারের মানুষজন দূরে থাকতে পারেন, কিন্তু আশেপাশের সমাজটা তো দূরে যায়নি। কাজেই বুড়ো বয়সে আর্থিক সংকট নেই, কিন্তু একা এমন মানুষজন যদি সাধ্যমত সামাজিক কাজে যোগ দেন, তাঁর ও সমাজের উভয়েরই লাভ। বাড়ির আশেপাশে এমন অনেক বাচ্চাকাচ্চা পাওয়া যাবে যাদের পড়ানো চলে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এতে সময় তো ভালই কাটার কথা। আরও অনেক সামাজিক কাজ আছে। তাতে যোগ দেওয়া যেতে পারে। তখন কিন্তু নিজেকে একা লাগবে না। বাবা-মা সামাজিক ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলে তাঁদের ভালই লাগবে। আর সমাজও এই অংশগ্রহণকারী বুড়ো মানুষদের সহায়তা করতে রাজি হবেন। অসুস্থ হলে ডাক্তার-বদ্যি ডাকার লোকের অভাব হবে না।
আমাদের সমাজে বাবা-মাকে অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত অধিকার দেওয়া হয়। আসলে যেন ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলা এক রকম বিনিয়োগ। অধিকাংশ সময় দেখা যায় বাবা-মায়েদের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সম্পর্কের দূরত্বের কারণ বাবা-মা ছেলেমেয়ের ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত অধিকারপরায়ণ। ভারতীয় বাবা-মায়েরা অনেক সময়েই ছেলেমেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করেন না। যেন ছেলেমেয়েরা বড় হলেও বাবা-মায়ের কাছে খোকা সেজে থাকবে। এই খোকা সাজা থেকেই বিয়ের সময় ছেলেরা মায়ের জন্য দাসী আনতে যেত। এই ভারতীয় সমাজই যযাতির গল্পের নির্মাতা। বুড়ো বাবা ছেলের যৌবনের অধিকার চাইছে। ছেলেকে বড় করেছে বলে যেন সে অধিকার তার আছে।
আমাদের দেশে রামকে আদর্শ চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়। রাম পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে গিয়েছিলেন। কিন্তু দশরথের অন্যায়ের বিচার করা উচিত। দশরথ মোহগ্রস্ত দশায় কৈকেয়ীর কাছে যে সত্য প্রদান করেছিলেন তা পালনের জন্য রামকে বনে যেতে হল। এতে দশরথের সত্য রক্ষার অহংকার চরিতার্থ হল কিন্তু সামাজিক ন্যায় রক্ষা হল কি! নিত্যদিনের সংসারে এমন অজস্র ছোট ছোট ঘটনা ঘটে যেখানে বাবা-মা তাঁদের অহং অধিকার চরিতার্থ করেন। এতে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সংকট ঘনায়। অনঙ্গবাবুর ঘটনা বাবা-মা ও ছেলেমেয়ের সম্পর্কের একটা দিককে তুলে ধরেছে, কিন্তু অন্য দিকটাও বিরল নয়। দায় ও দায়িত্ব কিন্তু উভয় পক্ষেরই।
|