আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস’। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা জানাইবার জন্য মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটি নির্দিষ্ট হইয়াছে। কুর্নিশ করা সহজ, হ্যাপা বহন করা কঠিন। গোটা বিশ্বে মহিলারা সন্তানধারণে আগ্রহ হারাইতেছেন। ব্রিটেনে দেখা গিয়াছে, এখন যে মহিলাদের বয়স ৪৫ বৎসর, তাঁহাদের মধ্যে সন্তানহীনতা ২০ শতাংশ, ইহা তাঁহাদের মায়েদের প্রজন্মের দ্বিগুণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬ শতাংশ মহিলার সন্তান নাই। উচ্চশিক্ষা এবং পেশাদারিত্বের সিঁড়িতে যে মেয়েরা আগাইয়া রহিয়াছে, সন্তানধারণে ইচ্ছা তাহাদের তত কম। বাড়তি রোজগার, কর্মক্ষেত্রে সাফল্য এবং স্বাধীন জীবনযাপনের আকর্ষণেই সন্তানের আকাঙ্ক্ষা কমাইতেছে। ‘সন্তানহীন মহিলা’ (চাইল্ডলেস ওম্যান’) না বলিয়া ‘সন্তানমুক্ত মহিলা’ (চাইল্ড-ফ্রি ওম্যান) বলাই রীতি হইয়াছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেও প্রতি দম্পতির পাঁচ-সাতটি সন্তান থাকিত। অতি দ্রুত আর্থিক উন্নয়ন, এবং মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা ও রোজগারের দ্রুত বৃদ্ধির পর আজ হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো দেশগুলিতে জনসংখ্যা কমিতেছে, অর্থাৎ জন্মের তুলনায় মৃত্যু হইতেছে বেশি। আর্থিক উন্নয়ন সত্ত্বেও পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থায় যথেষ্ট পার্থক্য রহিয়াছে মহিলাদের সিদ্ধান্তে তাহা প্রতিফলিত। পশ্চিমে বিবাহবহির্ভূত সন্তানধারণ বাড়িতেছে, এশীয় দেশগুলিতে মহিলারা বিবাহই করিতেছেন না, কিংবা দেরিতে করিতেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় পুরুষদের অভিযোগ, মেয়েরা ‘বিবাহ হরতাল’ করিয়াছে।
ভারতেও কি ইহারই ইঙ্গিত দেখা যাইতেছে? বণিকসভাগুলির সংগঠন ‘অ্যাসোচ্যাম’ কলিকাতা-সহ প্রধান আটটি শহরে এ বৎসর একটি সমীক্ষা করিয়াছে। দেখা গিয়াছে, ১২০০ কর্মরত ২৪-৩০ বৎসর বয়সী মহিলাদের অর্ধেকের অধিক উচ্চশিক্ষা এবং কর্মজীবনেই প্রধানত আগ্রহী, সন্তান ধারণের জন্য তাহা বিসর্জন দিতে তাঁহারা রাজি নহেন। অন্য দিকে, কর্মহীনতার জন্য সন্তানবতী গৃহবধূদের ২৫ শতাংশের আফশোস রহিয়াছে। অনেকে নিজের সামাজিক পরিচয় হারাইবার জন্যও আক্ষেপ করিয়াছেন। হয়তো আজও ইহা দেশের অধিকাংশ মহিলার মনোজগতের চিত্র নহে। তবু জন্মহার কমিতেছে, বিবাহ এবং মাতৃত্ব বহু মেয়ের নিকট পূর্বের গুরুত্ব লইয়া আসে না। ইহা স্পষ্ট হইয়াছে যে, নিজের জীবনযাপন বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইবার সুযোগ পাইলে ধর্ম-সংস্কৃতি-সমাজ ব্যবস্থা নির্বিশেষে মহিলারা তাহাই নির্বাচন করেন যাহা পুরুষরা চিরকাল করিয়া আসিয়াছেন স্বাধীন, সমৃদ্ধ জীবনযাপন। নারী যে পাঁচ সহস্র বৎসর ধরিয়া সন্তানের পরিচর্যা করিয়া আসিয়াছে, সে তাহার প্রকৃতিগত তাগিদের কারণে নহে, অন্য পন্থা না থাকিবার কারণে। জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি, সামাজিক বিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাহাকে যে শক্তি দিয়াছে, তাহা মাতৃত্বকে নিরুপায় প্রজনন হইতে নির্বাচিত সিদ্ধান্তে পরিণত করিয়াছে। সেই দৃষ্টিতে মাতৃত্ব ক্রমশ আরও মহিমময় হইয়া উঠিতেছে। |