|
|
|
|
জন্মসার্ধশতবর্ষে অনুত্তমের কবিপ্রণাম ‘রবীন্দ্ররচনাবিধান’ |
অশোককুমার কুণ্ডু • কলকাতা |
শহর কলকাতা থেকে দূরে মফফ্সল শহর মেদিনীপুরে বসে লিখে ফেলেছেন রবীন্দ্ররচনাবিধান। একেবারে একক উদ্যোগে কয়েক হাজার পাতা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। না, এই যুগেও সাহায্য নেননি কম্পিউটারের। ইন্টারনেট তো দূরঅস্ৎ। দীর্ঘ ৫০ বছরের নিরলস চেষ্টায় আঠারো খণ্ডের রবীন্দ্র রচনাভিধান ছাড়াও অনুত্তম লিখে ফেলেছেন আরও তেরোটি গ্রন্থ। যার মধ্যে সাতটি প্রকাশিত। সবই রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টি-কর্মকে ঘিরে।
কী আছে অনুত্তম ভট্টাচার্যের রবীন্দ্ররচনাভিধানে?
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় সৃষ্টি-কর্ম নিয়ে কে কোথায় লিখেছেন, কোন গ্রন্থে বা কোন পত্র-
|
অনুত্তম ভট্টাচার্য।
ছবি: কিংশুক আইচ |
পত্রিকায় কত সালে তা প্রকাশিত হয়েছে তারই নির্দেশ ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়। আর এ সব করতে গিয়ে অনুত্তমের সংগ্রহে এখন কয়েক হাজার খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকা, গ্রন্থ। ছিয়াত্তর বছরের এই ‘যুবকের’ সমস্ত কাজই মেদিনীপুরের মিরবাজারে নিজের বাড়ি, ‘কুসুমায়ত’-এ। প্রথম বই প্রকাশ ১৯৯১ সালে, দিনের আলোয় রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র রচনাভিধানের প্রথম খণ্ডের প্রকাশ ১৯৯৮ সালে।
শহর কলকাতায় না থেকে দূরে এই মফস্সল শহরে বসে এমন উদ্যোগ? শহরে তো তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সুবিধা হত। প্রশ্নটা আগেই আঁচ করেছিলেন অনুত্তম। বললেন, “মফফ্সল বলেই চড়া আলোর প্রলোভন ছিল কম। শান্ত জায়গা। তবে কলকাতা শহরের বড় বড় গ্রন্থাগার, ছড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল চিঠিপত্রে ও ফোনে। কিন্তু বেশিরভাগ জিনিস সংগ্রহ করতে হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে এবং অনেকটাই নিজের টাকায়। কোনও প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাহায্য পাইনি এবং চাইওনি।” রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনুত্তমের বইগুলির মধ্যে ‘নোবেল নাট্য’, ‘মৃণালিনী-রবীন্দ্রনাথ’, পঁচিশে বৈশাখ, প্রযোজনা, পরিচালনা ও অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখযোগ্য। সবই গবেষণা গ্রন্থ। রবীন্দ্ররচনাবিধানের প্রতিটি খণ্ড প্রকাশ ও প্রাপ্তির পরে পরেই বিশ্বভারতীর প্রাক্তন রবীন্দ্র অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত চিঠি লিখে উৎসাহ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রগবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য দিশা পত্রিকায় দীর্ঘ লেখায় বেদনা ও ক্ষোভে লিখেছেন, ‘আপনার দুর্ভাগ্য আপনি কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথের কালে না জন্মে জন্মেছেন আমাদের কালে, হযবরল হট্টগোলের বঙ্গদেশে’। দূর মফস্সলের এক রবীন্দ্র গবেষকের কাছে যা অন্যতম সেরা পুরস্কার।
গবেষকের কথায়, “আমার মাতৃকূল ও পিতৃকূল, দুই কূলেই ছিল রবীন্দ্র প্রদূষণ। ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ পিতৃপরিচয়হীন সত্যকমকে ব্রহ্মবিদঋ
ষি ‘সেরা’ ব্রাহ্মণ বিশেষণে বক্ষে ধারণ করিয়েছিলেন। তাই ব্রাহ্মণ্য, শিক্ষিত সমাজ রবীন্দ্রনাথকে বেশ অপছন্দ করতেন। অথচ আমার মাতৃকূল ও পিতৃকূল সে কালের যথেষ্ট পড়ুয়া, নবদ্বীপ সমাজের ছাত্র। পিতামহ আশুতোষ বেদান্তরত্ন। মাতামহ দ্বারকানাথ ন্যায়ভূষণ রচিত ‘কাব্যমঞ্জুষা’ তখনকার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিদ্যায়তনের পাঠ্য ছিল। পিতৃদেবের প্রয়াণের পরে, আমার তখন মাত্র চার বছর বয়স, দাদা-অনন্তকুমার আমাকে রবীন্দ্র অনুরাগী করে তোলেন। আজ যা হতে পেরেছি তা দাদার কীর্তি।”
কর্মবিমুখ বাঙালি চরিত্র নিয়ে কবি বলেছিলেন, ‘আমরা যাহা শুরু করি তাহা শেষ করি না।’ ১৯৩৯ সালে ডিসেম্বরের এক রাতে হুইল চেয়ারে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন মেদিনীপুর শহরে (প্রয়াণের মাত্র বছর দেড়েক আগে) ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতিমন্দির’ উদ্বোধনে। কল্পনা করা যাক, সেই ঘটনার তিয়াত্তর বছর পরে ফের কবি এসেছেন এখানে। তাঁর এই ‘আমরা’ থেকে নিশ্চয়ই মফ্ফসলের এই গবেষককে বাদ দিতেন। এমন কষ্ট কল্পের কথায় হেসে ফেললেন গবেষক। হাসতে হাসতে যোগ করলেন, “রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার আশীর্বাদ পেয়েছি, তা না হলে দীর্ঘ সময় ধরে, অতবড় মানুষটির জীবন নিয়ে এ কাজ শেষ করতে পারতাম না। জানি না মুদ্রণের পরে পরের সংস্করণের সংযোজন-বিয়োজন-সংশোধনের আর সময় পাব কি না। তবে প্রাথমিক কাজ তো হল। ভবিষ্যতে কেউ টেনে নিতে আসবেন।”
আশঙ্কা অমূলক নয়। তবু আমাদের প্রার্থনা এই গবেষকের জন্য। সুস্থ শরীরে থাকুন অনুত্তম। আরও কিছু তথ্য, যা পরে পেয়েছেন তা সংযোজন করে দিন। আরও ঋদ্ধ হোক রবীন্দ্ররচনাবিধান। |
|
|
|
|
|