ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া উলফ দাবি জানিয়েছিলেন, মেয়েদের চাই
নিজস্ব উপার্জন,
আর একটি নিজস্ব ঘর। আপন ঘরের কথাটা
নিজের
মতো
করে ভেবেছিলেন
আর এক জন। রবীন্দ্রনাথ। লিখছেন
বিশ্বজিৎ রায় |
এই দুহাজার বারোতেও মেয়েদের কি নিজের ঘর আছে? বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, সে তো আছেই, এমনকী স্বামীর ঘরও, কিন্তু নিজের ঘর? নিজের মতো জীবন যাপনের ঘর? অথচ নিজের ঘরের দাবি তো উঠেছিল অনেক আগেই। ১৯২৮-এর অক্টোবর মাস। ভার্জিনিয়া উলফ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ দুটি কলেজ থেকে ডাক পেলেন। বক্তৃতা দিতে হবে নিউনহাম আর গারটন কলেজে। কলেজ দুটি নারী শিক্ষার বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। ভার্জিনিয়া সেখানে যা বললেন তা বই হয়ে প্রকাশিত হল পরের বছর, ১৯২৯-এর অক্টোবর মাসে। A Room of Ones Own বইটি আকারে ছোট, গুরুত্বে কিন্তু মোটেই ছোট নয়। ভার্জিনিয়া দাবি করলেন, a woman must have money and a room of her own if she is to write fiction. যদি কোনও মহিলা স্বাধীন ভাবে উপন্যাস লিখতে চান তা হলে তাঁর চাই নিজস্ব একটি ঘর, তাঁকে হতে হবে উপার্জনক্ষম, তা না হলে স্বাধীন ভাবে পুরুষতন্ত্রের নজরদারি উপেক্ষা করে এক জন মেয়ের পক্ষে লেখালিখি চালিয়ে যাওয়া মুশকিল।
কতটা মুশকিল, তা তো ভার্জিনিয়া নিজের জীবন দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর বাবা সার লেসলি স্টিফেন ছিলেন বেশ ক্ষমতাশালী লেখক, সমালোচক ও শখের পর্বতারোহী। তিনি মনে করতেন মেয়েদের প্রথাগত ভাবে পড়াশোনা করার কোনও দরকার নেই, ইস্কুলে যাওয়ার অধিকার আছে শুধু পরিবারের ছেলেদের। এমন পরিবারে বড় হয়ে উঠেছিলেন ভার্জিনিয়া, কাজেই নিজের ঘরের অধিকার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি তাঁর।
যাঁদের দিকে লক্ষ্য রেখে ভার্জিনিয়া বক্তৃতামালা সাজিয়েছিলেন, বিলেতের কলেজের সেই শিক্ষিত মেয়েরাও অনুভব করতে পেরেছিলেন তাঁর কথা। পড়াশোনা মেয়েদের স্বাধীন রুচি আর বোধ দেয় বটে, কিন্তু সেই অনুযায়ী নিজের মতো জীবন যাপনের উপযোগী একখানা ঘর সমাজ দিতে চায় না। মেয়েদের তা আদায় করে নিতে হয়। কখনও সেই ঘর জোটে, কখনও জোটে না।
|
নিজের ঘর? সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’। |
ভার্জিনিয়ার বই যে বছর প্রকাশিত হয় সেই বছরেই, ১৯২৯-এ, এ দেশে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’। কুমুদিনী বলে একটি মেয়ের কথা ছিল এই উপন্যাসে। সে তার দাদা বিপ্রদাসের কাছে মানুষ। বিপ্রদাস ভার্জিনিয়ার বাবার মতো নন। তিনি বাপ-মা-হারা কুমুদিনীকে দাবা খেলা, ফোটোগ্রাফ তোলা, পিস্তল চালানো, এসরাজ বাজানো শেখালেন, সংস্কৃত ব্যাকরণ কাব্য পড়ালেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘এই দুই ভাইবোন যেন দুই ভাইয়ের মতো হয়ে উঠেছে।’
শিক্ষায় শরীর ও মন অনেকটা স্বাধীন হয়ে উঠলেও সেই শরীর আর মনের উপযুক্ত ঘর কি পেল কুমু? লম্বা ছিপছিপে শাঁখের মতো চিকন গৌর উনিশ বছরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হল ধনী ব্যবসায়ী মধুসূদন ঘোষালের। মধুসূদনের সঙ্গে তার বয়সের আর রুচির আকাশপাতাল পার্থক্য কুমু টের পেল, টের পেল এই পুরুষটিকে সে তার শরীর আর মন সমর্পণ করতে পারছে না। পতিগৃহে তার পালাবার একটিমাত্র জায়গা ছিল সেই বাড়ির রৌদ্র আর ছায়াভরা ছাদ। সেই ছাদে গেলে আশাবরী রাগের গান কুমুর মনে ভর করত। সেই গান বলত, ‘ও আমার বাঁশি, তোমাতে সুর ভরে উঠছে না কেন?’ সুরে ভরে না উঠলেও বিবাহিত পুরুষ তার অধিকার আর দাবি ছেড়ে দেবে, তা কি হয়! ব্যবসাদার মধুসূদন ছাড়েনি। মনহীন একটা শরীর ভোগ করল সে। আর উপভুক্ত কুমু? তার দুই চোখ লাল, ফোলা, পাঁশের মতো মুখের রঙ। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই যে একটুখানি ঢাকা ছাদ, সেখানে অবসন্ন ভাবে ঠেসান দিয়ে মাটিতে বসেছিল সে। এই প্রায় দাম্পত্য ধর্ষণের ফল গর্ভে ধারণ করেছিল কুমুদিনী। বোধহয় ভ্রূণহত্যাকে সমর্থন করতে পারেন না বলেই এবং তখনকার আইনে একক মাতৃপরিচয়ে সন্তান সামাজিক ভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে না বলেই রবীন্দ্রনাথ কুমুদিনী-মধুসূদনের বিচ্ছেদ ঘটাননি। কুমুদিনী দাদার বাড়ি চলে যায়, কিন্তু গর্ভসঞ্চার হয়েছে বুঝতে পেরে মধুসূদনের ঘরে ফেরে। ফিরতে বাধ্য হয়।
যোগাযোগের অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথের গল্প স্ত্রীর পত্র প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্র পত্রিকায় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। গোটা গল্পটা আসলে মৃণাল নামের মেয়েটির চিঠি। বিয়ের পনেরো বছর পরে সে ঘর ছেড়েছে। এই পনেরো বছর ধরে নানা ঘটনা আস্তে আস্তে তাকে এই ঘর ছাড়ার জন্য মনে মনে তৈরি করেছে। বুঝেছে সে, কলকাতার সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলির ওই ঘরটি তার স্বামীর ঘর, ভাশুরের ঘর, তার ঘর নয়। ওই গলিঘরেই তো অযত্নে আঁতুড়ে তার মেয়েটি জন্মেই মরে গেল। এ বাড়িতে তার কথার বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। মৃণাল লিখেছিল তার চিঠিতে, ‘কিন্তু আমার ঘর শুধু তো আমারই ঘর নয়’। তাই সে পনেরো বছর পরে ওই গলি ছাড়তে পারল। ১৯১৪ থেকে ১৯২৯, অনেক ক’টা বছরের ব্যবধান, তবু বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ লেগেই রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যেন লেগে থেকে খুঁজতে চাইছেন মেয়েদের নিজস্ব একটা ঘর। যে ঘরে বাপ, মা, বা অন্য কারও পরিচয়ে মেয়েটিকে থাকতে হবে না, নিজের মতো করে নিজের পরিচয়ে থাকতে পারবে সে। এ ঘর অবশ্য মেলা শক্ত। মেয়েরা তো বাস্তব অবস্থা আর দায়িত্বকে অস্বীকার করেন না। ১৯২৯-এ কুমুদিনী তাই আবার স্বামীর ঘরে ফেরে। নিজের ঘরের খোঁজটা তা বলে মিথ্যে হয়ে যায় না।
চলুন, এক বার নিজেদের ঘরের দিকে তাকাই। খবরের কাগজে চোখ রাখি। এখনও এ বঙ্গদেশে এম এ পাশ করে মেয়েরা যদি নিজের দায়িত্বে নিজের মতো থাকতে চান তা হলে অভিভাবকরা শিউরে ওঠেন। অভিভাবকের ইচ্ছে মেনে বিয়ের পাত্রী হিসেবে নিজেকে ছেড়ে দিতে কেউ না-ই চাইতে পারেন। এ চাওয়া বা না-চাওয়ার পিছনে অধিকাংশ সময়ে থাকে আত্মমর্যাদাবোধ। একটা বয়সের পর আমি ক’টায় বাড়ি ফিরব, কখন কোন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করব, কবে বিয়ে করব, কাকে করব, এ সব ব্যক্তিগত কথার জবাব কেউ না-ই দিতে চাইতে পারেন। তাঁদের এই ছোট ছোট চাওয়া না-চাওয়া থেকে আমাদের ছোট ঘরে মেঘ জমে ওঠে। সেই হেতুহীন চাপ থেকে বাইরে আসার জন্য নিজের উপার্জনে থাকার মতো নিজের ঘর খুঁজছেন অনেকে। এ খোঁজাটা হয়তো ভার্জিনিয়া, মৃণাল বা কুমুদিনীর জীবনের বড় সংকটের সঙ্গে মেলে না। মেলে না বলে তা উপেক্ষা করার মতো নয়। ছোটখাটো নুড়িগুলোকে তুচ্ছ করলে দেখা যাবে তা এক দিন বুকের ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে। স্বাধীন মনটাকে সেই পাথর মেরে ফেলবে। তাই নিজের ঘর খুঁজতেই হয়, হবে।
|
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |