বাসগৃহের বিদ্যুৎ সংযোগের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা শোচনীয়। এ রাজ্যে মাত্র ৫৫ শতাংশ গৃহে বৈদ্যুতিন আলো জ্বলে, বলিতেছে ২০১১ সালের গৃহস্থালি গণনা। অবশিষ্ট বাড়িগুলিতে এখনও কেরোসিনের লম্ফ ভরসা। বহু গ্রাহক দীর্ঘ দিন আবেদন করিয়া বসিয়া থাকেন, কিন্তু তাঁহাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় না রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। এই পরিস্থিতিতে কলকাতা হাই কোর্টের সাম্প্রতিক একটি রায় গুরুত্বপূর্ণ। এক গ্রাহকের অভিযোগের বিচার করিয়া কলকাতা হাই কোর্ট বলিয়াছে, যে সব অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ পরিকাঠামো রহিয়াছে, সেখানে আবেদনের এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হবে, অন্যথায় রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে।
এই রায়কে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানাইতে হয়। যে কোনও পরিষেবা সংস্থা গ্রাহকদের নিকট দায়বদ্ধ। জল-বিদ্যুতের ন্যায় অতি প্রয়োজনীয় পরিষেবা সরবরাহে বিলম্ব হইলে তাহা যে মানুষের নিকট কতখানি বিপন্নতার কারণ হইয়া ওঠে, তাহা সরকারি বা স্বায়ত্তাধীন সংস্থাগুলি প্রায় অগ্রাহ্য করিয়া চলে। ট্রান্সফর্মার বসে নাই, খুঁটি বসানো হয় নাই, তার টানা হয় নাই, এমন নানা অজুহাত দিয়া মাসের পর মাস বিদ্যুৎ সংযোগ লইয়া টালবাহানা করা প্রায় রীতি দাঁড়াইয়া গিয়াছে। কলকাতার রাজারহাট এলাকায় যদি বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে তিন মাসেরও অধিক সময় লাগিয়া যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে কী হইতেছে সহজেই অনুমেয়। বস্তুত এই কালক্ষয় শেষ অবধি অর্থক্ষয়ের আকার ধারণ করে। কারণ যে বাড়িগুলিতে সংযোগ দেওয়া হয় নাই, তাহারা ‘হুকিং’ করিয়া বিদ্যুৎ আহরণ করে। ইহা অবৈধ, এবং ঝুঁকির কাজ, কিন্তু বিদ্যুৎহীন গৃহস্থালির বাসিন্দাদের এ জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করিয়া দিলে তাঁহাদের প্রতি সুবিচার করা হয় না। তাঁহারা চাহিয়াও পান নাই, অতএব চুরি করিতেছেন। দৈনিক হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ সেই দৃষ্টিতে গ্রাহকের ক্ষতি এবং সরকারের ক্ষতি পূরণ করিবার জন্য কর্তাদের শাস্তি।
হাই কোর্টের এই রায়টির বহুল প্রচার প্রয়োজন, যাহাতে রাজ্যের সর্বত্র আবেদনকারীরা বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা টালবাহানা দেখিলে ক্ষতিপূরণের আবেদন করিতে পারেন। এই রায়কে একটি দৃষ্টান্ত রূপে রাখিয়া, পানীয় জল, রান্নার গ্যাস, প্রভৃতি অন্যান্য পরিষেবার ক্ষেত্রেও অকারণ বিলম্ব আটকাইতে হইবে নাগরিকদের। ইহা নাগরিক অধিকারেরই অন্তর্গত। বহু দেশে, এবং ভারতেরও নানা রাজ্যে, ‘নাগরিক দাবি সনদ’ তৈয়ারি করিয়াছে বিভিন্ন সংগঠন। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা হইতে কোন সময়ের মধ্যে কী পরিষেবা কী কী শর্তে নাগরিকরা দাবি করিতে পারে, তাহা স্পষ্ট লেখা হইয়াছে। সেই সঙ্গে ইহাও উল্লেখ করা হইয়াছে যে, সেই শর্ত না রাখিলে সরকারি কিংবা জনায়ত্ত সংস্থাকে কী ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। এক অর্থে ইহা সরকারি কর ব্যবস্থার প্রতিফলন বলিয়া ধরিতে হইবে। নাগরিকরা যথাযথ সময়ে কর না দিলে তাহাদের বাড়তি মাসুল গনিতে হয়। সরকার যথাযথ সময়ে পরিষেবা না দিলে গুনাগার দিবে না কেন? পরস্পর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করিলে তবেই একটি সার্থক সম্পর্ক গড়িয়া উঠিতে পারে। আদালত সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করিল। |