সাত বছর পরে গোরখপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের ‘নিখোঁজ’ যুবকের সন্ধান মিলল কলকাতার এক থানায়!
সোমবার দুপুরে সেখান থেকেই বাবা, কাকার সঙ্গে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করলেন বিজয়বাহাদুর সহানি। ‘ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে’ দিতে পেরে স্বস্তি ফিরল হেস্টিংস থানার পুলিশ এবং ফুটপাথের মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের।
বছর চারেক আগে মধ্য কলকাতার এস এন ব্যানার্জি রোড-তালতলা মোড়ের কাছে মৌলালির একটি মাজার চত্বরে নোংরা জামাকাপড়, উস্কোখুস্কো চুল-দাড়ির এক যুবককে দেখতে পান ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কয়েক জন কর্মী। তাঁরা জানান, নিজের মনে দিনভর কথা বলতেন ওই যুবক। কেউ কাছে ঘেঁষতে গেলে প্রচণ্ড বিরক্ত হতেন। নাম-পরিচয়হীন ওই যুবককে ‘চুনি’ বলে ডাকতে শুরু করেন সংগঠনের সদস্যেরা। খাবার দিয়ে তাঁর সঙ্গে ‘ভাব’ জমানোর চেষ্টাও চলে বহু দিন ধরে। প্রথম দিকে লাভ হয়নি। খাবার পড়ে থাকত। মাস চারেক পরে ধীরে ধীরে ‘বন্ধুত্ব’ হতে থাকে দু’পক্ষে। চুনিকে পরীক্ষা করেন এক মনোবিদ। তিনি জানিয়ে দেন, স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ওই যুবক। নিয়মিত ওষুধ দিয়ে সুস্থ করানোর চেষ্টায় কাজ দেয়। মাজারের এক কোণে সে সময়ে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। |
বাবার সঙ্গে বিজয়বাহাদুর সহানি। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র |
চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজের নাম মনে করতে পারেন চুনি। সংগঠনের সদস্যদের জানান, তাঁর আসল নাম হল বিজয়বাহাদুর সহানি। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা তখনও মনে করতে পারেননি বিজয়।
ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী সুখদেব সাউ, অভিষেক দাস, বাসন্তী দত্ত, শঙ্কর মইলিরা বিজয়ের কাছ থেকে তাঁর বাড়ির ঠিকানা জোগাড়ের চেষ্টা শুরু করেন। তাঁরা জানান, প্রতি দিন এ নিয়ে কথা বলা হত তাঁর সঙ্গে। সুখদেববাবু বলেন, “নিজের গ্রামের নাম ঠিকঠাক বলতে পারতেন না চুনি ওরফে বিজয়। তাঁর বাড়ির কাছের থানার নাম জানতে চাইলে এক বার বলতেন বেলঘাট, পরক্ষণেই তা বদলে যেত বেলগাঁও-তে। শেষে বুঝতে পারি বেলঘাটই ঠিক।”
হেস্টিংস থানার চত্বরেই কাজ চালায় ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। ওসি বলাই সাপুঁইয়ের নির্দেশে সাব-ইনস্পেক্টর জ্যোতির্ময় পাল যোগাযোগ করেন বেলঘাট থানায়। সেখানে বিজয়ের কথা জানানো হয়। মাস কয়েক আগে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের তরফে খবর যায়, খাজানি তালুকের জিগনিয়া উরস শাহপুর গ্রামে ওই যুবকের বাবা রামসমুচ সহানির কাছে। ভাই রাজবলীকে নিয়ে গত শনিবার শহরে পৌঁছন কৃষিজীবী ওই বৃদ্ধ। চিনতে পারেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে। পুলিশ জানায়, লুধিয়ানার একটি সোয়েটার প্রস্তুতকারক সংস্থায় কাজ করতেন বছর পঁয়ত্রিশের বিজয়। বছর সাতেক আগে সেখান থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি।
রামসমুচ জানান, ষোলো বছর বয়স থেকেই লুধিয়ানায় কাজ করতে যান তাঁর ছেলে। গ্রামে ফিরতেন মাঝেমধ্যে। বিয়ে করেছিলেন। তিনটি সন্তানও হয় তাঁর। এর পরেই আচমকা নিখোঁজ হয়ে যান বিজয়। রামসমুচ বলেন, “বাড়ি থেকে দূরে কোথাও আর যেতে দেব না ছেলেকে। এই ক’বছর যে কী ভাবে কেটেছে, তা ভগবানই জানেন।”
এ দিন দুপুরে থানার ঘরের এক কোণে জবুথবু হয়ে বসে ছিলেন বিজয়। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে আড়ষ্ট। ‘একটু হেসে দাও দেখি’স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক দাদার কথায় একগাল হাসি তাঁর মুখে। বিজয়ের পাশেই তখন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে বসে কলকাতার ফুটপাথে খুঁজে পাওয়া মহারাষ্ট্রের শোলাপুরের সুরেশ, নাগপুরের সুধাকর, বর্ধমানের গোপালেরা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক জন তাঁদের বললেন, “তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা। তোদের বাড়ি ফেরার সময়েও ক্যামেরা আসবে।” |