কঠিন। কঠোর। বলিষ্ঠ। সংগ্রামী।
কী লিখি!
আভিধানিক অর্থ এর কোনও একটা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ‘ফর্মিডেব্ল’ বলতে কী বোঝায়? মানে, যা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে বললেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশসচিব। যাঁর নিজের সম্পর্কে দেশবিদেশে এই বিশেষণটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তিনি কী বোঝাচ্ছেন?
বয়স ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে কয়েক মাস কম (১৯৪৭-এর ২৬ অক্টোবর জন্ম)। বারাক ওবামার সরকারে বিদেশসচিব পদে যোগ দেওয়ার পর আকাশেই বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন (৯৫টি দেশে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ মাইল চষা হয়ে গেল) পঁয়ষট্টির মহিলা। এমনই তাঁর সুটকেস-লালিত জীবন। কলকাতায় আসার আগেও ঘুরে এলেন চিন এবং বাংলাদেশ।
কিন্তু ভারতে এসে তো তাঁরা সাধারণত নয়াদিল্লিতেই গিয়ে থাকেন। কলকাতায় আসার কারণ সেই ১৯৯৭ সালে গত হয়েছেন মাদার টেরিজা। তবু প্রথমেই এখানে কেন?
কারণ তিনি দেখতে চেয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। |
মমতার শহর ছেড়ে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী। |
যিনি, ঘটনাচক্রে, মহিলা। নইলে কি আর দু-দু’বার আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী আইনজ্ঞের তালিকায় নাম-ওঠা, ইয়েল ’ল স্কুলের প্রাক্তন স্নাতক এবং ভবিষ্যতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সম্ভাবনাময়ী বলতেন, “ভোটের লড়াইয়ে কোনও মহিলার নির্বাচিত হওয়া কত কঠিন, আমি জানি!”
আর কী জানতেন?
জানতেন, ভোট-রাজনীতির ‘আগুনে পরীক্ষা’টা ঠিক কেমন। জানতেন, সেই ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় সফল হয়ে এক আটপৌরে মহিলার মুখ্যমন্ত্রিত্ব পাওয়ার কাহিনি। জানতেন সেই মহিলার ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’র কথা। জানতেন, তাঁর একক লড়াইয়ে এক অচলায়তন ভাঙার ইতিহাস। জানতেন, “শি হ্যাজ শ্যাটার্ড মেনি গ্লাস সিলিংস (ক্ষমতায় আরোহণের পথে বাধা। কাচের দেওয়ালের মতো দৃশ্যত ভঙ্গুর এবং আপাত-অদৃশ্য হলেও, বাধা)!”
কী জানতে চেয়েছিলেন?
জানতে চেয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিনি কী কী ভেবেছেন। তাঁর ‘ভিশন’ কী।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টনের সংক্ষিপ্ত মহাকরণ-সাক্ষাতের আগে শহরের বাছাই স্কুল ছাত্রছাত্রী এবং সমাজের একাংশের সঙ্গে আলোচনায় বলেছিলেন একদা আমেরিকার ‘ফার্স্ট লেডি’। যিনি নিজের সম্পর্কে ‘ফর্মিডেব্ল’ শব্দটা শুনে হাসি-সংবলিত কপট বিস্ময় প্রকাশ করলেন। হেসে ফেললেন এই প্রশ্ন শুনে, ২০১৬-য় কি আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁকে দেখা যাবে? বললেন, “আমাদের দেশের সমস্যা হল, ভোটে লড়ার সব খরচ প্রার্থীকেই তুলতে হয়। পুরুষ হোন বা মহিলা। আমার তো খুব খাটুনি গিয়েছিল। আমি বাবা ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হতে চাই না! ওটায় খুব ঝামেলা। তবে কোনও মহিলাকে অবশ্যই প্রেসিডেন্ট হিসেবে জীবদ্দশায় দেখতে চাই।”
এ সবই অবশ্য লঘু চাপল্য এবং নির্দোষ অনৃতভাষণ। রাজনীতিকরা প্রকাশ্য জনসংযোগে অহরহ করে থাকেন। সেই উচ্ছ্বাসের ফেনাটুকু বাদ দিলে ইলেকট্রিক-ব্লু প্যান্ট-স্যুট, কব্জিতে হিরের রিস্টলেট এবং কানে ঝকমকে দুলের হিলারি খুব সোজাসাপ্টা। যিনি বলেছিলেন, “আমার কলকাতা সফরের অন্যতম কারণ খুচরো পণ্যে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা। আমি এর পিছনের রাজনীতিটা জানি। ওঁর অবস্থানও জানি। এ-ও জানি যে, এগুলো করতে সময় লাগে। কিন্তু আমি চাইব, এই বাজারটা এ রাজ্যে খুলে দেওয়া হোক।”
মহাকরণের সাক্ষাতে মমতাকে কি তিনি সে কথা বলেছেন?
মমতা নিজে জানাচ্ছেন, না। তা হলে? মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এ সব বৈঠকের তো প্রোটোকল থাকে। বেশি কথাবার্তার সুযোগ ছিল না। কিছু-কিছু বিষয়ে কথা হয়েছে। ওঁর সঙ্গে ১৯৯৯ সালে আলাপ হয়েছিল। ওঁকে মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বললেন, ‘টাইম ম্যাগাজিনে’র অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কে আমার সঙ্গে দেখা হবে বলে আশা করেছিলেন। আমি বললাম, এক দিনের নোটিসে আমেরিকা যাব কী করে?”
আর?
হিলারিকে গুচ্ছ উপহার-দেওয়া মমতা বললেন, “জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, আমার কাজের প্রতি প্যাশনটা ওঁর দারুণ লাগে। বললেন, সিপিএম ক্ষমতায় থাকার ফলে এখানে বিনিয়োগ করতে পারেনি আমেরিকা। এ বার করবে। মিটিংটা ভাল হয়েছে। ওঁকে আমার বেশ পজেটিভ, কনস্ট্রাকটিভ আর ওয়ার্ম লাগল।”
এ-ও, অবশ্যই, মুখ্যমন্ত্রীর তরফে, সৌজন্যমূলক। যিনি তখনও জানেন না হিলারির সঙ্গে তাঁর বৈঠক নিয়ে সংক্ষিপ্ত মার্কিন বিবৃতিতে লেখা থাকবে, খুচরো পণ্যে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়েও তাঁদের আলোচনা হয়েছে! দ্রুত যার পাল্টা বিবৃতি দিয়ে তাঁকে বলতে হবে, এটা ঠিক নয়। ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ হল!
যে বিবৃতিতে হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টনও বিলক্ষণ বুঝবেন, সোমবার দুপুরে যে মহিলার সঙ্গে তাঁর কুশল-বিনিময় হয়েছিল, তিনি যথার্থই ‘ফর্মিডেব্ল’! তাঁর মতোই। যিনি অক্লেশে আরও একটা কাচের দেওয়াল ভেঙে ফেললেন।
কঠিন। কঠোর। |