বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েও মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের কলকাতা-সফরকে কটাক্ষ করতে ছাড়ল না সিপিএম। দেশের খুচরো ব্যবসার বাজার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দিতে সিপিএম তাদের আপত্তি বজায় রেখেছে। মূলত এই প্রেক্ষিতেই হিলারি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা ফের দাবি করেছে, ভারত সরকার যেন কোনও ভাবেই মার্কিন চাপের কাছে ‘নতিস্বীকার’ না-করে। খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) মেনে নিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করানোই হিলারির সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এমনটা ধরে নিয়েই সমালোচনার রাস্তায় গিয়েছে সিপিএম।
রাজ্যের স্বার্থে বিদেশি বিনিয়োগ এলে তাঁদের আপত্তি নেই এবং দেশে-দেশে সুসম্পর্ক বজায় রাখার তাঁরা পক্ষপাতী, স্পষ্ট করেই সেই কথা সোমবার কলকাতায় বলেছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিম। কিন্তু সেই সঙ্গেই তাঁর মন্তব্য, “দু’জনের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে, এখনও পরিষ্কার নয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এফডিআই নিয়ে আলোচনা হয়নি। কিন্তু ঠিক কী হয়েছে, পরে জানা যাবে। হিলারি দেশে ফিরে যাওয়ার পরে ও দেশের সংবাদমাধ্যম বা অন্য কোথাও হয়তো বেরোবে! ‘উইকিলিক্সে’ আমরা জেনেছিলাম, কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল ওয়াশিংটনে ‘নোট’ পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রীকে চর্চা (কাল্টিভেট) করা উচিত বলে! এখন ফসল তোলার (হারভেস্ট) সময় এসেছে মার্কিন প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরা আসছেন!” |
মহাকরণের গোলটেবিলে মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টন
ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার। নিজস্ব চিত্র |
যে ‘উইকিলিক্সে’র সূত্র ধরে সিপিএম নেতারা মমতা-মার্কিন সম্পর্ককে কটাক্ষ করছেন, সেই ওয়েবসাইটেই বাম জমানায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কিছু মতামত প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, পুরনো ধ্যানধারণা ভেঙে না-বেরোলে সিপিএম ‘লয়প্রাপ্ত’ (পেরিশ) হবে। বিনিয়োগের প্রশ্নে দলকে আরও উদার হতে হবে। এমনকী, ওয়ালমার্টের মতো খুচরো ব্যবসায়ী সংস্থাকে এ রাজ্যে ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন বলেও কোনও কোনও মহল থেকে বলা হয়েছিল। বুদ্ধবাবু অবশ্য তৎক্ষণাৎ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, ওয়ালমার্টকে নিয়ে আসার পক্ষে তিনি কখনও কোনও কথা বলেননি। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটও বিবৃতি দিয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। সেলিম এ দিন বলেন, “বিনিয়োগের বিষয়ে বামপন্থীদের আপত্তি নেই, এ তো আমরা বরাবরই বলেছি। খুচরো ব্যবসায় এফডিআই-এর প্রশ্নটা আলাদা। তা ছাড়া, বিনিয়োগ নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যা আলোচনা, সবই হয়েছিল মার্কিন অর্থ দফতরের কর্তা বা রাষ্ট্রদূতের। মার্কিন বিদেশসচিব তো বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে ঘোরেন না!”
সিপিএম নেতৃত্ব বোঝাতে চেয়েছেন, মার্কিন বিদেশসচিবের কলকাতা-সফরের সঙ্গে যে ভাবে বিনিয়োগ প্রস্তাবের বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কাঠামোর সঙ্গে তা একেবারেই মেলে না। সেলিমের বক্তব্য, বিনিয়োগের বিষয়ে কিছু করণীয় থাকলে মার্কিন বাণিজ্যসচিব বা আমেরিকা-ভারত বাণিজ্য পরিষদের মাধ্যমে তা হতে পারে। নিদেনপক্ষে, বণিক সভাগুলি দু’দেশের শিল্পপতিদের নিয়ে আলোচনা করতে পারে। মার্কিন বিদেশ সচিব যদি এ দেশে খুচরো ব্যবসায় এফডিআই-এর সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে যান, তা হলে তাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নাক গলানো’ হিসাবেই দেখতে হবে। তবে এর পরেও সেলিম বলেছেন, হিলারির সফরের জেরে রাজ্যে সাধারণ ভাবে বিনিয়োগ এলে তাঁরা খুশিই হবেন। |
এর সঙ্গেই তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গ এনে ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে মার্কিন ‘খবরদারি’র বিরুদ্ধে ‘হুঁশিয়ারি’ দিতে চেয়েছে সিপিএম। দিল্লিতে এ দিন দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেছেন। আজই রবীন্দ্রনাথের সার্ধ-শতবর্ষ উদযাপনের শেষ দিন। ঠিক এমন দিনে কলকাতায় গিয়ে মার্কিন বিদেশসচিব ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন!” তাঁর যুক্তি, দু’টি সার্বভৌম রাষ্ট্রের পারস্পরিক বিষয়ে আমেরিকার ‘হস্তক্ষেপ’ দু’দেশের কাছেই চিন্তার বিষয়। পলিটব্যুরোর বৈঠক শেষে বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, হিলারির এই ভারত সফরের উদ্দেশ্যই হল খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়া। এই দু’টি বিষয়ে এ দিন সংসদেও সরব হয়েছে সিপিএম।
হিলারির সফরের দিনে ‘সাম্রাজ্যবাদে’র বিরুদ্ধে ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ জানাতে ডিওয়াইএফআই এবং এসএফআই-কে দিয়ে কলকাতায় মিছিলও করিয়েছে সিপিএম। প্রতিবাদে পথে নেমেছে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের ছাত্র-যুবরাও। হিলারির বিমান অবশ্য তত ক্ষণে কলকাতা ছেড়ে গিয়ে দিল্লিতে নেমে পড়েছে! |