মার্কিন বিদেশসচিবের সফর ঘিরে সেই দুপুর থেকে উচ্ছ্বসিত ছিল রাজ্য প্রশাসন। রাতে তা কিছুটা হলেও বদলে গেল মতান্তরে। ‘সৌজন্যে’ মার্কিন দূতাবাসের জারি করা প্রেস বিবৃতি। যাতে বলা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে খুচরো ব্যবসায় মার্কিন লগ্নির বিষয়ে কথা বলেছেন হিলারি ক্লিন্টন।
বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির (এফডিআই) বিষয়টি মমতার কাছে অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’। মন্ত্রিসভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েও তাঁর আপত্তিতেই পিছিয়ে আসতে হয় কেন্দ্রকে। দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিগত এই বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বিদেশি অতিথির সঙ্গে আলোচনা করতে চাননি মমতা। (কারণ, কথা হলেই বিরোধীরা যে মার্কিন হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে সরব হবে, তা মমতা বিলক্ষণ জানেন) মহাকরণ সূত্রে দাবি, আলোচনা হয়ওনি। বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, তিস্তা জল প্রকল্প, এফডিআই এবং টাটা গোষ্ঠী নিয়ে কোনও কথা হয়েছে কি না। মমতা বলেন, “উনি জিজ্ঞাসা করেননি। আমরাও কিছু বলিনি।”
|
...সেইখানে যোগ তোমার সাথে |
বিশ্বসাথে যোগে: বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনেও রবীন্দ্রনাথ। উপহার হিসেবে হিলারি ক্লিন্টনের
দেওয়া আসনটি দেখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার, মহাকরণে। ছবি: রাজীব বসু |
এমনকী মার্কিন দূতাবাসের তরফে রাজ্য সরকারের কাছে যে খসড়া বিবৃতি পাঠানো হয়েছিল, তাতেও এফডিআই প্রসঙ্গ ছিল না। কিন্তু সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানতে পারেন, বিবৃতিতে বিষয়টি জোড়া হচ্ছে। তিনি তৎক্ষণাৎ মার্কিন কনসাল জেনারেল ডিন টমসনকে ফোন করে রাজ্যের আপত্তির কথা জানিয়ে দেন। পাঠিয়ে দেন সরকারি চিঠিও। কিন্তু তার পরেও বিবৃতিতে লেখা হয়েছে: ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় বিদেশসচিব ক্লিন্টন যে সব বিষয় ছুঁয়ে গিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে খুচরো ব্যবসা-সহ পশ্চিমবঙ্গে মার্কিন লগ্নি...।’
অথচ এ দিন হিলারির সঙ্গে বৈঠক সেরে দৃশ্যতই উচ্ছ্বসিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মার্কিন বিদেশসচিব বিদায় নেওয়ার পরে এই সফরকে রাজ্যের পক্ষে ‘গর্ব করার মতো ঘটনা’ আখ্যা দিয়ে সাংবাদিকদের মমতা বলেন, “পজিটিভ, কনস্ট্রাকটিভ, ক্রিয়েটিভ ও কংক্রিট বৈঠক হয়েছে। হিলারি এখানে এসেছেন। এটাই বড় পরিবর্তন। রাজ্যে পরিস্থিতি পাল্টেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ রাজ্যে লগ্নি করতে চায়। পশ্চিমবঙ্গকে ‘অংশীদার রাজ্য’ হিসেবে পেতে আগ্রহী তারা।” বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে সমন্বয় করার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল এবং মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
২১ গাড়ির কনভয় নিয়ে হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টন যখন মহাকরণের পোর্টিকোয় নেমে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে দোতলার সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়লেন, অতিথিকে স্বাগত জানাতে তখন দরজায় উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী। রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দু’জনের কিছু ক্ষণ কথা। সেখান থেকে কনফারেন্স রুমে। শুরু হয় ৫২ মিনিটের মহাবৈঠক।
কলকাতায় মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি প্রথম পা রেখেছিলেন ১৭৯৪ সালে। বঙ্গের সঙ্গে মার্কিন সরকারের প্রায় ২২০ বছরের সেই সম্পর্কের কথা হিলারিকে স্মরণ করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে বাম আমলে শিল্প ও কৃষিতে রাজ্যের ‘পিছিয়ে পড়া’র ইতিহাস শোনান। পরে সাংবাদিকদের মমতা বলেন, “রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে বিনিয়োগ করছিল না। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। এ বার বিনিয়োগের লক্ষ্য হবে এই রাজ্য।” বৈঠকে হিলারি মন্তব্য করেন, আগে এই রাজ্য স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেই কারণেই মার্কিন বিনিয়োগ ছিল কম।
লগ্নির ক্ষেত্র হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি, ম্যানুফ্যাকচারিং, পর্যটন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা হিলারিকে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে তিনি বলেন, “হিলারি আগ্রহ দেখিয়েছেন। রাজ্যকে সাহায্য করতে তাঁরা প্রস্তুত। অনেক ক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ হতে পারে।” হলিউড-বলিউড-টলিউডের সমন্বয়ে বিনোদন শিল্পে বিনিয়োগের কথাও বলেছেন তিনি। মমতার কথায়, “আমি বলেছি, শাহরুখ খান আমাদের রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। ওঁরা বলেছেন, তাঁদের দেশে শাহরুখ খুব জনপ্রিয়। আমি বলেছি, আমরাও হলিউডের ছবি দেখি। পর্যটন ও বিনোদনে বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান বেশি হবে।”
এফডিআই-এর মতো আর একটি স্পর্শকাতর বিষয় হল, বাংলাদেশ। ঢাকার সঙ্গে, বিশেষ করে হাসিনা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী কেন্দ্র। এ ব্যাপারে উৎসাহী ওবামা প্রশাসনও। কারণ, সন্ত্রাসবাদ। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, মুম্বই বিস্ফোরণের পরে নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে পশ্চিম উপকূল ছেড়ে পূর্ব উপকূলকে লক্ষ্য করেছিল পাক সমর্থনপুষ্ট জঙ্গিরা। বাংলাদেশকে ঘাঁটি করে ভারতে সন্ত্রাস আমদানি শুরু করেছিল তারা। হাসিনা ক্ষমতায় এসে কড়া হাতে তা দমন করেছেন। তাই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি বিপদে পড়ুন সেটা দিল্লি যেমন চায় না, তেমনই চায় না ওয়াশিংটন। তাই তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন মনমোহন। কিন্তু মমতার আপত্তিতে তা আপাতত স্থগিত।
এ দিন তিস্তা প্রসঙ্গ না-উঠলেও সামগ্রিক ভাবে এই উপমহাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে কথা হয়েছে বলে মহাকরণ সূত্রে খবর। বাংলাদেশের নাম না-করে হিলারি বলেছেন, “প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল হওয়া উচিত।” মমতা তাঁকে বলেন, “আমাদের লক্ষ্যও তাই। কিন্তু রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে কিছু করব না।”
হিলারি হঠাৎ এ রাজ্যে কেন এলেন? মমতার জবাব, “উনি বললেন, নিউ ইয়র্কে টাইম ম্যাগাজিনের অনুষ্ঠানে (এ বছর ওই পত্রিকা দু’জনকেই বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী মহিলার তালিকায় রেখেছে) ভেবেছিলাম আপনার সঙ্গে দেখা হবে। আপনি সারা জীবন লড়াই করেছেন জেনে দেখা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আপনি যাননি বলে আমিই চলে এলাম।” |
লগ্নির আমন্ত্রণ |
• তথ্যপ্রযুক্তিতে |
• পাহাড়, জঙ্গলমহল, তরাই-ডুয়ার্স, দিঘা, জোড়াসাঁকোয় পর্যটনে |
• দু’টি ফিল্ম সিটিতে ডিজিটাল, অ্যানিমেশন শিল্পে |
• হলিউড-বলিউড-টলিউডের সমন্বয়ে বিনোদন শিল্পে |
• প্রস্তাবিত ২৭টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে |
• বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে সমন্বয়ের দায়িত্বে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল ও রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ |
|