অবশেষে স্বর্ণশিল্পের সিংহভাগ দাবি মেনে নিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখেপাধ্যায়। বাজেটে প্রস্তাবিত যে-সমস্ত শুল্ক নিয়ে স্বর্ণশিল্পে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল, তার প্রায় প্রতিটি থেকেই সোমবার সরে আসার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল কেন্দ্র। এই সিদ্ধান্তে গয়না ব্যবসায়ীরা মোটের উপর খুশি। তবে ক্রেতার উপর বাড়তি দামের বোঝা তেমন কমবে না বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। পাশাপাশি, কাঁচা সোনা কেনায় শুল্ক না-ওঠায় লগ্নি ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা জানিয়েছেন কাঁচা সোনার ব্যবসায়ীরা।
যে-সব প্রস্তাব এ দিন বাতিল করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে:
(১) নগদে ২ লাখ টাকার উপরে সোনার গয়না কিনলে ক্রেতার কাছ থেকে কর আদায়ের প্রস্তাব
(২) ব্র্যান্ডেড ও ব্র্যান্ডেড নয়, সব গয়নায় উৎপাদন শুল্ক বসানোর প্রস্তাব
তবে যে সমস্ত শুল্ক থাকছে, সেগুলি হল:
• ৫ লক্ষ টাকার উপর গয়না কিনলে ক্রেতার উপর ১ শতাংশ হারে কর
• নগদে ২ লক্ষ টাকার বেশি কাঁচা সোনা কেনার উপর ১ শতাংশ কর
• সোনার আমদানি শুল্ক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব
এ বারের বাজেটে স্বর্ণশিল্পের উপর একাধিক কর বসানোর প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এর প্রতিবাদে দেশ জুড়ে আন্দোলনে নামেন গয়না ব্যবসায়ী ও স্বর্ণশিল্পীরা। কর প্রস্তাবগুলি তুলে নেওয়ার দাবিতে টানা ২১ দিন সারা দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা তাঁদের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ রাখেন। আন্দোলনের মুখে অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দেন, যথাসময়ে তাঁদের দাবিগুলি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র।
অর্থমন্ত্রী সোনার উপর কর বসানোর ব্যাপারে তাঁর বাজেট প্রস্তাবে যে-সব সংশোধন এনেছেন, তাতে অবশ্য ক্রেতার উপর বাড়তি বোঝা তেমন লাঘব হয়নি বলে মনে করছেন স্বর্ণশিল্প মহলের অনেকেই। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে সোনায় লগ্নির পরিমাণ কমতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বুলিয়ন বা কাঁচা সোনার ব্যবসায়ীরা। কলকাতার বুলিয়ন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক অনিল আঢ্য বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার যে পদক্ষেপ করেছে, তাতে সোনায় লগ্নি কমতে পারে। কারণ, এক দিকে আমদানি শুল্কের হার বৃদ্ধি, অন্য দিকে ২ লক্ষ টাকার বেশি কাঁচা সোনা কেনার উপর নতুন করের প্রস্তাব সোনা কেনা থেকে নিরুৎসাহিত করবে লগ্নিকারীদের।”
প্রণববাবু অবশ্য প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, সোনায় লগ্নি করায় তিনি উৎসাহ দিতে চান না। কারণ, তাঁর মতে সোনা ‘ডেড অ্যাসেট’ বা অকেজো সম্পদ। স্বর্ণশিল্প মহলের ধারণা, এই কারণেই অর্থমন্ত্রী সোনা আমদানির উপর শুল্ক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব অপরিবর্তিত রেখেছেন। শিক্ষা সেস-সহ মোট আমদানি শুল্ক অবশ্য পড়বে ৪.১২ শতাংশ। তবে অনিলবাবুর মতো অন্য স্বর্ণ ব্যবসায়ীদেরও আশঙ্কা, আমদানি শুল্ক বাড়ায় চোরাপথে সোনা আমদানি বাড়তে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং নেপাল থেকে।
অর্থমন্ত্রী বিশেষ করে উৎপাদন শুল্কের প্রস্তাব ফিরিয়ে নেওয়ায় খুশি দেশের সোনার গয়না শিল্প মহল। অল ইন্ডিয়া জেম অ্যান্ড জুয়েলারি ট্রেড ফেডারেশন, জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিল, স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমটি-সহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাব সংশোধনকে স্বাগত জানিয়েছে। স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটির কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে বলেন, “আমাদের প্রধান দাবি ছিল উৎপাদন শুল্কের প্রস্তাব তুলে নেওয়া। অর্থমন্ত্রী, তা মেনে নেওয়ায় আমরা খুশি।”
তবে গয়না শিল্প মহল খুশি হলেও বাজেট প্রস্তাবগুলির জেরে ক্রেতার উপর গয়নার দামের যে বোঝা বেড়েছিল, প্রস্তাব সংশোধনের ফলে তা কিন্তু তেমন কমেনি বলে মন্তব্য করেছেন অল ইন্ডিয়া জেম অ্যান্ড জুয়েলারি ট্রেড ফেডারেশনের পরিচালন পর্ষদের অন্যতম ডিরেক্টর হর্ষদ আজমেরা। তিনি বলেন, গয়নার সোনার সোমবারের গড় দামের (প্রতি ১০ গ্রাম সোনা ২৯,০০০ টাকা) ভিত্তিতে হিসাব করলে বাজেট প্রস্তাবগুলি কার্যকর হলে দাম বাড়ত ১৫৭৮ টাকা করে। উৎপাদন শুল্ক তুলে নেওয়ার ফলে তা মাত্র ৯৩ টাকা কম বাড়বে। ২ লক্ষ টাকার বেশি গয়না কেনার উপর যে-কর বসানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা কার্যকর না-হওয়ার ফলে আরও ২৯০ টাকা দর বাড়ার হাত থেকে রেহাই মিলবে। ফলে ক্রেতারা মোট ছাড় পেলেন প্রতি ১০ গ্রামে ৩৮৩ টাকা। অর্থাৎ নিট হিসাবে বাজেট প্রস্তাবের জেরে সোমবারের গড় দামের ভিত্তিতে প্রতি ১০ গ্রাম সোনার গয়নার দাম বাড়ল ১১৯৫ টাকা। |