আর্থিক মন্দার আশঙ্কা ছিলই। তার মধ্যেই ভারতের শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি লগ্নি বিদায় নিতে পারে বলেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে তাই নরম মনোভাব নিতেই হল। দেশের বাজারে লগ্নিকারীদের কর ফাঁকি রুখতে বাজেটে কড়া নিয়মবিধি কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। আজ নিজেই পিছু হটে জানিয়ে দিলেন, এখন নয়, আগামী ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষ থেকে নতুন ব্যবস্থা চালু হবে। প্রণবের এই ঘোষণার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে শেয়ার সূচকেও। যৎসামান্য হলেও চাঙ্গা হয়েছে শেয়ার বাজার। দিনের শেষে সেনসেক্স ছিল ১৬,৯১২ অঙ্কে, যা গত শুক্রবারের তুলনায় ৮১.৬৩ পয়েন্ট বেশি।
ভোডাভোনের কর মামলায় কিন্তু কোনও ছাড় ঘোষণা করেননি প্রণব। আজ লোকসভায় অর্থ বিল নিয়ে বিতর্কের শুরুতেই তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন। পরে অর্থ মন্ত্রক সূত্রেও জানা গিয়েছে, ভোডাফোন বিষয়টি নিয়ে যে নোটিস সম্প্রতি পাঠিয়েছে, অর্থ বিল পাশ হয়ে গেলেই তার জবাব পাঠাবে কেন্দ্র। ভোডাফোনের অভিযোগ, আয়কর আইন সংশোধনের প্রস্তাব এনে বিদেশি লগ্নি সুরক্ষা চুক্তি ভেঙেছে ভারত। এই পরিপ্রেক্ষিতে এখনই তাদের সঙ্কে আলোচনার পথে যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকার।
রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর মনোনয়ন নিয়ে জল্পনার মধ্যেই আজ প্রণববাবুর বাজেট ও অর্থ বিল নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আর তাই বিতর্কে অংশ নিয়ে যশবন্ত সিন্হার মতো নেতারা মজা করতেও ছাড়েননি। নিজের বক্তৃতার শুরুতেই মন্তব্য করেছেন, “ক্ষমা চেয়ে শুরু করছি। যদি এই বাজেট অধিবেশনের পরে অর্থমন্ত্রী বড় বাড়িতে চলে যান, তা হলে আজ যা সমালোচনা করব, তা নিয়ে যেন রাগ পুষে না রাখেন।” পরেরবার বাজেট অধিবেশনে প্রণব আর অর্থমন্ত্রী থাকবেন কি না, তা নিয়ে ‘সংশয়’ প্রকাশ করেছেন। আবার কখনও রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে আম-আদমির জন্য বাড়তি বোনাস দিয়ে যাওয়ারও ‘অনুরোধ’ করেছেন তিনি। বিরোধী নেতার সরস মন্তব্যে প্রাণ খুলে হেসেছেন প্রণবও। তিনি পরিহাস করে এ কথাও বলেন, “আপনারা তো দেখছি আমাকে অর্থ মন্ত্রক থেকে তাড়াতে বদ্ধপরিকর।” |
হাসি মুখ দেখা গিয়েছে শিল্পমহলেও। কর ফাঁকি রুখতে যে কড়া নিয়মবিধি কথা ঘোষণা করেছিলেন, তা পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে আজ স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল। বণিকসভাগুলির মতে, এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা হলেও কাটবে। প্রণববাবু জানান, করদাতা ও কর আদায়কারীদের কাছে নতুন নিয়মবিধি (জেনারেল অ্যান্টি-অ্যাভয়ডেন্স রুল্স) আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। সে জন্যই পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক কাটাতে প্রণব কিছু সংশোধনও ঘোষণা করেছেন। জানিয়েছেন, কর ফাঁকি নিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করার দায় প্রশাসনের, করদাতার নয়।
ভোডাফোন-হাচিনসের মতো ব্যবসায়িক লেনদেনকে করের আওতায় আনতে আয়কর আইনে বিশেষ সংশোধনী প্রস্তাবের কথা বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রস্তাব অনুযায়ী, ভারতে ব্যবসা থাকলে, ভারতীয়, অনাবাসী বা বিদেশি, সবাইকেই ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য কেন্দ্রের ভাঁড়ারে কর জমা করতে হবে। লেনদেন বিদেশের মাটিতে হলেও তা করের আওতায় আসবে। আজ প্রণব নিজের পুরনো অবস্থানেই অনড় থেকেছেন। তাই ভোডাভোনের কাছ থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা কর ও জরিমানার দাবি জানাতেও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও বাধা নেই। তবে ভোডাফোন ও ব্রিটিশ সরকারের আবেদনের ভিত্তিতে, জরিমানা বাবদ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার অংশটি ছাড় দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর।
অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের ব্যাখ্যা, ৮২টি দেশের সঙ্গে ভারতের ‘ডাব্ল ট্যাক্সেশন অ্যাভয়ডেন্স এগ্রিমেন্ট’ রয়েছে। ওই সব দেশে একবার কর দিলে ভারতে আর দ্বিতীয়বার কর দিতে হয় না। কিন্তু এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে কর খুবই কম বা শূন্য। এইসব দেশের সঙ্গে ভারতের তাই চুক্তি নেই। কর এড়াতে ভারতে ব্যবসারত বহু সংস্থা ওই সব দেশে লেনদেন করে বা সেখান থেকে ঘুরপথে লগ্নি করে।
ঠিক যেমনটা হয়েছিল ভোডাফোনের ক্ষেত্রে। ২০০৭-এ ব্রিটিশ সংস্থা ভোডাভোন হংকংয়ের হাচিসন-এসারে-র ৬৭% শেয়ার কিনে নেয়। হাচিসনের ব্যবসার একটা বড় অংশ ভারতে হলেও লেনদেনের চুক্তি সই হয় ক্যারিবীয় সাগরের কেম্যান আইল্যান্ডে। যে দেশের সঙ্গে ভারতের কর-সম্পর্কিত কোনও চুক্তি নেই। বিদেশের মাটিতে চুক্তি সই হয়েছে, এই যুক্তি দেখিয়ে ভোডাভোন কোনও কর দিতে চায়নি। সুপ্রিম কোর্টে মামলার রায়ও ভোডাফোনের পক্ষেই যায়। তারপরেই বাজেটে আয়কর আইন সংশোধনের পথে হাঁটে কেন্দ্র। |