অনিল বসুর ‘বিদ্রোহ’ নিয়ে ‘বিড়ম্বনা’র মধ্যেই আলিমুদ্দিনকে আরও ‘অস্বস্তি’তে ফেললেন সিপিএমের আরও এক প্রাক্তন সাংসদ অমিতাভ নন্দী। রাজ্যকমিটি থেকে বাদ পড়ে ‘ক্ষুব্ধ’ই ছিলেন অমিতাভবাবু। শনিবার তিনি রাজ্য নেতৃত্বের কাছে আবেদন জানান, তাঁকে এ বার উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমন্ডলী থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হোক।
গত বৃহস্পতিবার দলের বৈঠকে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর কাছেই ওই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন অমিতাভবাবু। যদিও তাঁর ইচ্ছাপূরণ হয়নি। পঞ্চায়েত ভোটের আগে জেলায় দলে গোষ্ঠী রাজনীতির ‘ভারসাম্য’ রক্ষা করতে তাঁকে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে রেখে দেওয়া হয়েছে।
দলীয় বৈঠকে বিমানবাবুর সামনেই অমিতাভবাবু বলেন, কেন তাঁকে রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হল, তা নিয়ে বার বার জানতে চাওয়া সত্ত্বেও রাজ্য নেতৃত্ব কোনও জবাব দেয়নি। যদি কোনও ‘বিশেষ কারণে’ তিনি রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়েন, তা হলে কী জন্য তাঁকে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে রাখা হচ্ছে? এটা ‘অনুচিত’। তিনি আর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকতে চান না। সাধারণ কর্মী হিসাবে দলের কাজ করতে চান। দলীয় সূত্রের খবর, ওই কথা বলে অমিতাভবাবু বিমানবাবু এবং জেলা সম্পাদক গৌতম দেবের উপর ‘পাল্টা চাপ’ দিতে চেয়েছিলেন। বৈঠকে একাধিক জেলা কমিটির সদস্যও একই কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন আবার অমিতাভবাবুর ‘ঘনিষ্ঠ’।
বিমানবাবু বৈঠকে কিছু না-বললেও গৌতমবাবু বলেন, দলে অমিতাভবাবুর যথেষ্ট ‘গুরুত্ব’ আছে বলেই তাঁকে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীতে নেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু জানতে চাইলে অমিতাভবাবুকে নিয়ে গৌতমবাবু নিজে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে যেতে পারেন। শনিবার বারাসত জেলা পার্টি অফিসে দলীয় বৈঠকেও অমিতাভবাবু সম্পাদকমণ্ডলী থেকে ‘অব্যাহতি’ চান। তা-ও গ্রাহ্য হয়নি। এখন তিনি ওই মর্মে লিখিত আবেদন করেন কিনা, সেটাই দেখার। অনিল-কান্ডের মধ্যেই অমিতাভবাবুর ঘটনা নিঃসন্দেহেই সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বকে আরও ‘অস্বস্তি’তে ফেলবে। অনিলবাবুর মন্তব্য নিয়ে দলের ‘বিড়ম্বনা’ স্পষ্ট বিমানবাবু এ দিন ওই বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য এড়িয়ে যাওয়ায়। আরামবাগের প্রাক্তন সাংসদ অনিলবাবুকে ‘দুর্নীতি ও স্বজনপোষণে’র দায়ে দল থেকে সাসপেন্ড করায় তিনি বিমানবাবু এবং দলের একাংশের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। অনিলবাবুর স্ত্রী সবিতাদেবী বিমানবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার হুমকিও দিয়েছেন। কিন্তু বিমানবাবু ওই বিষয়ে নীরবতা বজায় রাখাই ‘শ্রেয়’ মনে করেছেন। |
এ দিন সকালে কার্ল মার্ক্সের মূর্তিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদককে ওই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “অনিল বসুকে নিয়ে আমি আগেও কিছু বলিনি। এখনও বলতে চাই না। সংবাদমাধ্যমে কারও মন্তব্যের উপরে পাল্টা মন্তব্য বন্ধ করতে চাই, বন্ধ করতে চাই, বন্ধ করতে চাই!”
তবে এ দিনই সকালে আলিমুদ্দিনে বিমানবাবু এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর ঘরোয়া বৈঠকে অনিলবাবুকে নিয়ে কথা হয়। ছিলেন সিপিএমের হুগলি জেলার সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীও। দলের জেলা নেতৃত্বের বক্তব্য, ক্ষোভ বা অভিযোগের ব্যাপারে অনিলবাবু কিছু জানাননি। এই পরিস্থিতিতে অনিলবাবুর ব্যাপারে আরও ‘কড়া পদক্ষেপ’ করা হবে, নাকি তাঁর সাসপেনশনের মেয়াদ (তিন মাস) ফুরনো পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে, তা নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিমত আছে। অনিলবাবুর ‘বিদ্রোহে’র পিছনে অন্য কারও মদত আছে কিনা, তা-ও বুঝে নিতে চাইছে আলিমুদ্দিন। তাই চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়ারই সম্ভাবনা।
কাল, রবিবার এবং পরশু, সোমবার দিল্লিতে সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠক। সেখানে যোগ দিতে এ দিনই দিল্লি রওনা হয়েছেন বিমানবাবু। তিনি এবং এ রাজ্য থেকে দলের পলিটব্যুরোর অন্য সদস্যরা বৈঠক শেষে কলকাতায় ফেরার পরে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে অনিল-প্রসঙ্গ নিয়ে আবার আলোচনা হতে পারে। বস্তুত, দিল্লি যাওয়ার সময় যাতে তাঁকে এ নিয়ে আবার সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়তে না-হয়, সে জন্য নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই বিমানবাবু আলিমুদ্দিন থেকে বিমানবন্দরে রওনা হয়ে যান বলে দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
হুগলি জেলার আরামবাগের সাত বারের সাংসদ অনিলবাবুর (গত লোকসভা ভোটে তিনি হারেননি। আরামবাগ আসনটি ‘সরংক্ষিত’ হয়ে যাওয়ায় সেখানে তিনি দাঁড়াননি) প্রকাশ্য ‘বিদ্রোহে’ যথেষ্টই ‘অস্বস্তিতে’ আলিমুদ্দিন। ঘরোয়া আলোচনায় নেতারা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও প্রকাশ্যে তাঁরা খুব একটা মুখ খুলতে নারাজ। তবে এ দিন শিলিগুড়িতে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলী এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী বিমানবাবুর প্রতি অনিলবাবুর মন্তব্যকে ‘অন্যায়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “বিমান বসু অনিলবাবুকে সাসপেন্ড করেননি। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে সিদ্ধান্ত হওয়ার পরই তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। তিনি বিমান বসুর বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তা অন্যায়। এটা তিনি ঠিক করেননি। আপাতত এর বেশি কিছু বলব না।”
বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক এই প্রশ্নে বড় শরিক সিপিএমের ‘পাশে’ই দাঁড়িয়েছে। দিনহাটার ফব বিধায়ক উদয়ন গুহ বলেন, “সংবাদমাধ্যমে অনিলবাবু ও তাঁর স্ত্রী সবিতাদেবীর বক্তব্য জেনেছি। ভদ্রমহিলা এতদিন কোথায় ছিলেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, তখন ওঁর স্বামী তাঁকে অশালীন ভাষায় গাল দিয়েছেন। এক সময়ে তিনি হাতে মাথা কাটতেন বলে শুনেছি। তখন তো উনি স্বামীকে সংযত করেননি! তা যদি করতেন, তা হলে এখন সাংবাদিক বৈঠক করতে হত না। আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।” |