দাদার কীর্তি মনে রেখেও ইডেনে কেকেআর বরণ
‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন...।’
ব্যস, ওই অবধি এসে থেমে যেতে হবে। পরের লাইনগুলো গলায় এসেও আটকে যাবে কাণ্ডকারখানা দেখলে। ‘এক হউক, এক হউক, হে ভগবান’ গেয়ে ওঠার কোনও ‘সিন’-ই নেই! শনিবার বৈশাখী মাঝ-দুপুরে ময়দান চত্বরে বিলকুল উলটপুরাণ। এক হওয়া তো দূরস্থান, এ তো বরং কলকাতা তথা বাংলার ‘ভাগ হউক ভাগ হউক’-এর চাক্ষুষ চিত্রনাট্য। সেই দেড়টা থেকেই শুরু ‘ইডেন চলো’ আন্দোলন। রেড রোডের মুখটায় মিনিটখানেক দাঁড়ালেই বঙ্গভঙ্গের ছবিটা পরিষ্কার। বাদশা বনাম মহারাজ। দাদা বনাম খান। কলকাতা ভার্সেস শহরের আইকন। যত দূর চোখ যায় কালো মাথার মিছিলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে শেষ না হওয়া গাড়ির স্রোত। সামলাতে রাস্তায় গলদঘর্ম পুলিশের ছোট-মেজ-বড় কর্তারা। বঙ্গবাসী মাঠের সামনে ‘কে-কে-আর’ স্লোগান দিয়ে ওই যে মাঠমুখী উনিশ-কুড়ির দঙ্গল সোনালি-বেগুনি জার্সি গায়ে। আর ওই শুনুন পাল্লা দিয়ে ‘দাদা’ ‘দাদা’ চিৎকার গোষ্ঠ পালের স্ট্যাচুর গা ঘেঁষে। ময়দান মার্কেটে যা গত দু’দিনে বিকিয়েছে শয়ে শয়ে, পুণের সেই আকাশি নীল জার্সি গায়ে দেখুন, ‘কত সেনা চলেছে সমরে!’
কাদের গলার জোর বেশি? কাদের দিকে একটু বেশি হেলে সমর্থনের দাঁড়িপ্লালা? কে বলে দেবে? আবেগের উথালপাথাল এ ভাবে ভাগ হয়ে গেলে কী ভাবেই বা বলবে? নানা ঘটনা পরম্পরায় স্বদেশে পরবাসী হয়ে পড়া ঘরের ছেলের হয়ে গলা ফাটানোর জাত্যভিমান, নাকি ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যের চৌকাঠ পেরিয়ে প্রিয় শহরের নামধারী টিমকে বরণ? ঘড়িতে তিনটে পঁচিশ-- ম্যাচ শুরুর আধ ঘণ্টা আগের বুলেটিন: অ্যাডভান্টেজ কেকেআর।
‘বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার মন, বাংলার মাঠ....।’
হর্ষ-বিষাদ
ম্যাচের সেরা সুনীল নারিনকে নিয়ে
সতীর্থদের উল্লাস। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
আউট হয়ে ফিরছেন সৌরভ।
ছবি: উৎপল সরকার
এখানে অবশ্য পরের লাইনটা স্বচ্ছন্দে গেয়ে দেওয়া যায়। প্রতীকী অর্থে। ‘পূর্ণ হউক।’ শনিবার ইডেনের ‘পূণর্র্ হউক’ নিয়ে কোনও সংশয় কোনও কালেই ছিল না। কিন্তু ‘বাংলার মাঠ’ যে ম্যাচ শুরুর আধ ঘণ্টা আগেই পূর্ণ হতে চলল বলে। লোক ধরে হাজার পঁয়ষট্টি, নব্বই ভাগ তো এখনই ভর্তি। ঘণ্টা দেড়েক আগে পুণের টিম বাস ক্লাবহাউসের গেটে এসে ব্রেক কষেছে। আর এই প্রথম, নিজের শহরে নিজের আশৈশব চেনা মহল্লায় অতিথিদের ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়েছেন তিনি। আর পরিচিত চেহারাটা যখন প্রথম মাঠে পা রাখল, তখন গ্যালারি থেকে যে গর্জন উৎপন্ন হল, ডেসিবলে সেটা মাপার মতো যন্ত্র এখনও বাজারে আসেনি। বি ব্লক থেকে পাল্টা এল, ‘করব লড়ব জিতব রে।’ এটা ডেসিবলে মাপার মতো। ধ্বনিভোট যদি সূচক হয়, দুই ক্যাপ্টেন টস করতে যাওয়ার মিনিট পনেরো আগে অবধি অন্তত ইডেনে আবার অ্যাডভান্টেজ দাদা।
‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা...।’
কিন্তু কোনটা ‘সত্য হউক’ সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। বাঙালির আশা না সৌরভ? বাংলা মানে তো কলকাতাও। আর কলকাতা মানে কেকেআর। গম্ভীর আউট হতে হঠাৎ গ্যালারিতে গ্যালারিতে নীলের দাপাদাপি! দেখে মনে হতে পারে করাচিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে সচিনের উইকেট গেল! আবার পুণে যখন একের পর এক উইকেট হারাচ্ছে, দাদা নামেননি, ক্লাবহাউসের আপার টিয়ারে প্ল্যাকার্ড সহারা কর্তাদের জন্য উঠে গেল, ‘বে-সহারা পুণে!’ তখন আবার অ্যাডভান্টেজ কেকেআর। একেবারে ৭০-৩০।
শেষ বলটা হওয়ার পরে সামান্য উত্তেজিত লাগছিল গম্ভীরকে। নাইট অধিনায়ক অবশ্য বলছেন, “ওটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ। খেলতে খেলতে হয়ে যায়। সৌরভ এখানে কিংবদন্তি। ভারত ও বাংলার হয়ে অনেক করেছে। জানতাম ওর জন্য সমর্থন থাকবে। কিন্তু কেকেআরকে মানুষ যে ভাবে সমর্থন করলেন, আমি অভিভূত। এই শহরে ম্যাচ। মানুষ যে ভাবে মাঠে আমাদের জন্য গলা ফাটালেন, তাতে কৃতজ্ঞ।” তার পরেই যোগ করেন, “দিল্লি বনাম কেকেআর ম্যাচ কোটলায়হলে আমার জন্য এই সমর্থন থাকবে না। কারণ দাদা কলকাতার জন্য যা করেছে, আমি দিল্লির জন্য তেমন কিছু করিনি।”
একটার পর একটা পুণের উইকেট পড়ছিল আর গ্যালারিতে গ্যালারিতে উড়ছিল কেকেআর পতাকা। বি ব্লকের রেলিংয়ের কোণে দাঁড়িয়ে পুত্র-কন্যাকে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে পুণে ইনিংসে মাঠে আসা শাহরুখ। কখনও হাততালি দিচ্ছেন, কখনও গ্যালারিকে বলছেন, “আরও চাই, আরও!” তখনও সৌরভ নামেননি। ক্লাবহাউসের আপার টিয়ারে তখন জনৈক কেকেআর ভক্ত সহারা কর্তাদের জন্য প্ল্যাকার্ড তুলে ধরলেন, ‘বে-সহারা পুণে!’ যত সময় গিয়েছে, ব্যক্তি ও তার কীর্তিকে ভুলে সমষ্টির দিকে ঝুঁকেছে কলকাতা, সমর্থনে ভরিয়ে দিয়েছে কেকেআর-কে।
যুদ্ধ শেষ। কলকাতা জিতেছে, পুণে হেরেছে। অধোবদন পুণে অধিনায়ক যখন ডাগআউটে ফিরছেন, ‘বিজিত’ দাদাকে যে ভালবাসায় ভরিয়ে দিল ইডেন, সেটা সাধারণত বিজয়ী নায়কদের জন্য বরাদ্দ থাকে। স্রেফ চিৎকারে আর বুক ভরা ভালবাসায়। ব্লকে ব্লকে উড়তে থাকা ‘দাদা উই স্টিল লাভ ইউ’ বা ‘মহারাজা তোমারে সেলাম’ পোস্টারে। প্রায় ফেয়ারওয়েল দেওয়ার মতো। আইপিএলে হয়তো এই শেষ বার, তা হলে ইডেনেও তো ভূমিপূত্রের সম্ভাব্য বিদায়বেলা। বেরসিক ডিজে ওই সময়ও বাজিয়ে যাচ্ছে নাইটদের ‘টু হট, টু কুল’ গান। ডিজে বেচারিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আবেগ, সহানুভূতি ও জাত্যভিমান মিলে যে অনুভূতি তখন ঠাসা ইডেন প্রসব করছে, সেটাকে কী করেই বা শব্দের আধারে ধরবে ‘ঝিঙ্কা চিকা’ জাতীয় জগঝম্প? ধরা যেত, যদি ভাঁড়ারে থাকত কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’। ‘তুমি’ মানে দাদা। দাদাকে ডেকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে মাঠে ঘুরছেন শাহরুখ, খেলার পরে অন্তত ওই সময়টুকু ‘প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত’ এবং শেষ পর্যন্ত দাদাকেই চাইল এবং সেই চাওয়ার প্রবল স্পন্দন সারা মাঠের সঙ্গে ছুঁয়ে গেল জনৈক ‘মাই নেম ইজ খান’-কেও। যিনি ম্যাচ জিতেও বুঝে গেলেন একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে হার-জিতে ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম আইকনকে মাপা যায় না। তিনি নিজে বলিউডের বাদশা হতে পারেন, কিন্তু পৃথিবীর এই ভূখণ্ডে দাদাই ‘বাজিগর’!
স্কোর বলবে, কেকেআর জিতেছে, ওয়ারিয়র্স হেরেছে। সাধে আর কি স্কোরবোর্ডকে গাধা বলে? এই ম্যাচের স্কোর দিয়ে জেতা হারার অঙ্ক মাপে কার সাধ্যি? এক দিকে শহরের নাম জড়িয়ে থাকা টিমের জয়যাত্রায় সোচ্চার শরিক হওয়া। পাশাপাশি ঘরের ছেলেকে উজাড় করে দেওয়া ভালবাসা। একদিকে ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমষ্টিকে আবাহনের পরিণত প্রকাশ। পাশাপাশি এত বছর ধরে চাক্ষুষ করা ‘দাদার কীর্তি’-কে ভুলতে না চাওয়া নস্ট্যালজিয়া।
‘কলকাতা বনাম কলকাতা’-র টক্করে শেষমেষ জিতল কলকাতা-ই। ‘এক’-কে ছাপিয়ে ‘বহু’, ব্যক্তিকে অতিক্রম করে সমষ্টি আর অমুক বনাম তমুক ডিঙিয়ে ক্রিকেট। সংঘর্ষ, বাইশ গজের রণক্ষেত্রে ‘সবার উপরে ক্রিকেট সত্য, তাহার উপরে নাই!’




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.