ক্রমশ ভিড় ঘন হতে শুরু করেছে বিজ্ঞান ভবনে। একে একে আসতে শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রীরা।
কিছুটা দূর থেকে নীতীশ কুমারকে দেখে কার্যত ছুটেই এলেন নরেন্দ্র মোদী। মনে কিছুটা কুণ্ঠা নিয়ে এগোলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রীও। হাত বাড়ালেন মোদী। শক্ত করমর্দন। দুই নেতাকে ছেঁকে ধরল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। প্রায় মিনিট খানেক। হাত ছাড়তেই দিলেন না মোদী। করমর্দনের পরেও উভয়ে হাসিমুখে কথা বললেন কিছুক্ষণ।
কী কথা হল দু’জনের? এক গাল হেসে মোদী বললেন, “অনেক বিষয়ে কথা হয়েছে।”
মাত্র কয়েকটি মিনিট। চার পাশে কৌতূহলী দৃষ্টি। ‘অনেক বিষয়’ নিয়ে কথা বলার অবকাশও ছিল না। কিন্তু ক্যামেরার সামনে ওই করমর্দনেই ‘অনেক’ বার্তা দিলেন মোদী। সপ্তাহ খানেক আগে এই বিজ্ঞান ভবনেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠক ছিল। সেখানেও উপস্থিত ছিলেন এই দুই নেতা। কিন্তু মোদী ও নীতীশ একে অপরের দিকে ফিরেও তাকাননি, এমনকী আলোকচিত্রীদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও। বৈঠকে মোদী কিন্তু অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছিলেন। পরে তামিলনাড়ু ভবনে গিয়ে জয়ললিতা এবং ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠকও করেছেন। |
সেই করমর্দন। এনসিটিসি বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী ও নীতীশ কুমার। শনিবার। ছবি: পি টি আই |
আজ হঠাৎ অন্য ছবি কেন? নরেন্দ্র মোদীর থেকে যিনি সচেতন ভাবে দূরত্ব বজায় রেখে এসেছেন, মোদীকে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করলে যিনি এনডিএ ছেড়ে দেবেন বলে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়েছিলেন, সেই নীতীশের কি আজ মত পরিবর্তন হল?
মিনিটখানেকের করমর্দন নিয়ে রাজধানীতে জল্পনা শুরু হওয়ায় ঘনিষ্ঠ মহলে নীতীশ জানিয়েছেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীই তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে এসেছিলেন। তাঁর কথায়, “আমি নিছক রাজনৈতিক সৌজন্য দেখিয়েছি। এই ঘটনার আর কোনও অর্থ নেই।” নীতীশ যা-ই বলুন, তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ আরজেডি এবং কংগ্রেস কিন্তু সুর চড়িয়েছে। আরজেডি নেতা তথা বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আব্দুল বারি সিদ্দিকি বলেন, “মোদীর বিরুদ্ধে নীতীশের জেহাদ আসলে দ্বিচারিতা। ওঁদের ‘বন্ধুত্ব’ এত দিনে প্রকাশ্যে এল!” একই সুরে নীতীশের সমালোচনা করে কংগ্রেস নেতা অশোক চৌধুরি বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতার নাম করে মোদীর সঙ্গে নীতীশ যে দূরত্ব বজায় রাখেন, তা আসলে লোকদেখানো। আজ হাসিমুখে দু’জনের করমর্দনেই তা স্পষ্ট হয়েছে।”
প্রশ্ন উঠছে, ‘বরফ’ গলাতে মোদী হঠাৎ এগোলেন কেন?
বিজেপির এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, মোদী ধীরে ধীরে নিজেকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। সাম্প্রতিক অতীতে আরএসএসের সঙ্গে যেটুকু মনোমালিন্য ছিল, তা-ও ঘোচানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। সঙ্ঘ নেতৃত্ব মোদীকে বার্তা দিয়েছেন, পরের লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে তুলে ধরতে আরএসএসের আপত্তি নেই। কিন্তু সে জন্য মোদীকেই সব দলের সমর্থন জোগাড় করতে হবে। সেই সূত্র ধরেই মোদী সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। জয়ললিতা, নবীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন। মার্কিন পত্রিকায় বিশ্বের শক্তিশালী ব্যক্তিদের তালিকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আসার পর তাঁকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভবিষ্যতে যে দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলার কৌশল নিচ্ছে বিজেপি, তাদের সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি। আর সেই অঙ্কেই নীতীশের সঙ্গে এই করমর্দন।
কিন্তু নীতীশ?
জেডি(ইউ) সূত্রের মতে, নীতীশ সুকৌশলে তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে জোট বাধার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তিনি ভালই জানেন, ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বিহারে ভোটে জিততে হয় জাতির সমীকরণ ও উন্নয়নের প্রশ্নে। ফলে জয়ললিতা বা নবীনের মতো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মুখ্যমন্ত্রীরা যখন মোদীকে গ্রহণ করছেন, তখন দৌড়ে পিছিয়ে থেকে লাভ কী? আর সঙ্ঘ ও বিজেপি যদি সত্যিই মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে, তা হলে বিজেপির সঙ্গত্যাগ করার অর্থ বিহারে সরকারের পতনের পথ প্রশস্ত করা। কারণ, বিজেপির সঙ্গ ছাড়া এখনই বিহারে একার ক্ষমতায় সরকার গঠন করা নীতীশের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মোদীকে এখন উপেক্ষাও করতে পারছেন না নীতীশ। আবার ভোট-অঙ্কের কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাঁকে। তাই করমর্দন-কাণ্ডকে যতটা সম্ভব ‘লঘু’ করে দেখানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে কোথায়? রাজ্য-রাজনীতিতে এই ঘটনা ঘিরে বিতর্ক তো শুরুই হয়ে গিয়েছে! |