ভাঙড় কলেজের শিক্ষিকা দেবযানী দে’র থুতনিতে এক্স-রে করানোর পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তারেরা। তাঁদের আশঙ্কা, কোনও ‘টিস্যু’ ছিঁড়ে ভিতরে রক্তক্ষরণের ফলেই ব্যথা জিইয়ে আছে। যে কারণে ভাঙড়ের নলমুড়ি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকেরা শনিবার তাঁকে ইঞ্জেকশন ও যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ দিয়েছেন।
দেবযানীর অভিযোগ: গত ২৪ এপ্রিল তিনি কলেজের স্টাফরুমে প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তথা কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি আরাবুল ইসলাম ও তাঁর সঙ্গীদের হাতে ‘আক্রান্ত’ হয়েছিলেন। তখনই একটি জলের জগ এসে লাগে তাঁর থুতনিতে। তবে শারীরিক ক্ষত ছাপিয়ে মানসিক আঘাতটাই ওঁকে আপাতত বেশি কষ্ট দিচ্ছে। দেবযানীকে ‘হেনস্থা’র অভিযোগে পুলিশি তদন্ত শুরু হলেও ঘটনার জেরে তাঁর পেশাগত যোগ্যতা ও মর্যাদা ‘ক্ষুণ্ণ’ করার প্রয়াসেও ওই শিক্ষিকা মানসিক ভাবে ‘বিধস্ত।’
রবিবার দেবযানী বলেন, “কখনও ভাবিনি, শিক্ষক হিসেবে আমার যোগ্যতা ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। জগটা থুতনিতে লাগায় আমার চোট যতটা লেগেছে, মানসিক আঘাতটা তার ঢের বেশি।” পাশাপাশি নিউ আলিপুরে তাঁর বাপের বাড়ির ভাড়াটের সঙ্গে ‘গোলমালের’ বিষয়ে খোঁজ নিতে রবিবার পাড়ায় পুলিশ যাওয়াটাও দেবযানীকে উদ্বেগ এবং আশঙ্কার মধ্যে রেখেছে বলে তাঁর ঘনিষ্ঠমহলের খবর।
সামগ্রিক ভাবে আরাবুল-বাহিনীর হাতে তাঁর ও অন্য শিক্ষকদের ‘আক্রান্ত’ হওয়ার ঘটনাটি নিয়েও প্রশাসনের একাংশে অযথা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বলে দেবযানী মনে করছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের কাছে জমা দেওয়া সংশ্লিষ্ট অভিযোগপত্রে ‘জগ ছোড়া’র উল্লেখ না-থাকলেও স্পষ্ট লেখা হয়েছে, ‘কলেজের স্টাফরুমে আরাবুল ও উন্মত্ত জনতা চড়াও হওয়ার পরে পরিস্থিতি হিংসাত্মক চেহারা নিত, যদি না কয়েক জন শিক্ষক শারীরিক নিগ্রহ ও হুমকি সহ্য করে তাঁদের বাধা দিতেন।’ দেবযানী-সহ ভাঙড় কলেজের ন’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা অভিযোগপত্রটিতে সই করেছেন। কলেজের স্টাফরুমে শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ যে দেবযানী করেছেন, পুলিশের করানো ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টেও তার উল্লেখ আছে।
ইতিমধ্যে আরাবুলের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, গালিগালাজ ও মহিলার সঙ্গে অভব্যতা ইত্যাদির অভিযোগে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। সব ক’টাই জামিনযোগ্য ধারায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের বক্তব্য, জগ ছোড়ার বিষয়টি দেবযানী তদন্তকারী অফিসারকে জানানোর পরে তা নিয়েও তদন্ত হচ্ছে। কলেজের স্টাফরুম থেকে পুলিশ ইতিমধ্যে একটি জগ বাজেয়াপ্ত করেছে। এ দিন সন্ধ্যায় কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বলেন, “ভাঙড় কলেজের ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগ নথিবদ্ধ হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। তার ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ দিকে ভাঙড়-কাণ্ডের জেরে দেবযানী ও তাঁর কিছু সহকর্মীর ‘নিরপেক্ষতা’ সম্পর্কে রাজ্য প্রশাসন তথা তৃণমূলের তরফে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে ওই কলেজের এক শিক্ষিকা মালিকা সেন এ দিন বলেন, “২০০৬-এ এই কলেজেই ইউনিয়ন ভোটে কারচুপি ঠেকাতে আমি, দেবযানীদি ও আরও বেশ কয়েক জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রাতে ব্যালট বাক্স পাহারা দিতে থেকে গিয়েছিলাম। কোনও রাজনৈতিক দলের স্বার্থরক্ষায় নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে।” বস্তুত ভাঙড় কলেজের শিক্ষকদের অনেকেরই দাবি, বাম জমানায় রাজ্যের শাসকদল সিপিএমের ‘ধামাধরা’ হয়ে চাকরি পেয়ে থাকলে তাঁদের কখনওই ভাঙড়ের মতো প্রত্যন্ত এলাকার কলেজে নিয়োগ করা হতো না।
একই সঙ্গে নিউ আলিপুরে তাঁর বাপের বাড়ির পাড়ায় এ দিন পুলিশ যাওয়াতেও ঘনিষ্ঠমহলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেবযানী। তাঁর বাপের বাড়ির ভাড়াটে দেবাশিস ঘোষের অভিযোগকে ‘হাতিয়ার’ করে রাজ্য সরকার তথা তৃণমূল দু’দিন আগে আসরে নেমেছিল। খাস মহকরণে দেবযানীদের বিরুদ্ধে ভাড়াটের অভিযোগ ‘তুলে ধরতে’ উদ্যোগী হয়েছিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে দেবযানীর স্বামী রাজ্য পঞ্চায়েত দফতরেরই আধিকারিক, এবং তাঁর বদলির চাকরির কারণেই দেবযানী বাপের বাড়িতে থাকেন বলে তিনি জানিয়েছেন। এ দিন পুলিশ অবশ্য নিউ আলিপুরে গিয়ে দেবযানীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেনি। তাঁদের কয়েক জন প্রতিবেশীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে। পুলিশ ওখানে গেল কেন?
লালবাজারের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “এমনিতে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সমস্যায় পুলিশের কিছু করার নেই। কিন্তু কোনও অশান্তির খবর পেলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে।” যদিও বাড়িওয়ালার ‘চরিত্র হননের’ লক্ষ্যে ভাড়াটেকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছে বাড়িওয়ালাদের সংগঠন জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি অফ দি হাউসওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।
তবে এত সবের মধ্যেও পুলিশি-তদন্তে দেবযানীর ভরসা আছে। শুধু তা-ই নয়, কলেজে শান্তি ফেরানোর ব্যাপারেও তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে আস্থা রাখছেন বলে এ দিন জানিয়েছেন ওই শিক্ষিকা। |