|
|
|
|
সিপিএম করলে পড়ানো যাবে না কলেজে, ফতোয়া দিলেন শঙ্কুদেব |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কলেজে পড়াতে গেলে সিপিএম করা চলবে না বলে এ বার ‘ফরমান’ জারি করলেন শাসক তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা।
ভাঙড় কলেজে গোলমালের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই এলাকায় প্রতিবাদ-মিছিল করে তৃণমূল। মিছিল-শেষে থানার সামনে এক পথসভায় শঙ্কু সরাসরি হুঁশিয়ারি দেন, “অধ্যাপনার মুকুট পরে কলেজে সিপিএম করবেন, তা হতে দেব না! ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব!” কলেজ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্পর্কে ওই ছাত্রনেতার আরও বক্তব্য, “সিপিএমের আমলে বাপ-ঠাকুর্দাদের ধরে চাকরি পেয়েছে! কলেজে পড়ানোর কোনও যোগ্যতাই নেই!” পরে প্রশ্ন করায় শঙ্কু ফের বলেন, “কলেজে পড়াতে গেলে সিপিএম করা চলবে না। এটাই আমাদের দাবি।”
তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, এই ঘটনা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-বিক্ষোভের পরের ধাপ। দলের অন্য একটি অংশ অবশ্য বলছে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-সহ তিন প্রবীণ শিক্ষককে বুধবার থেকে টানা ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ঘেরাও করে রাখার পিছনে যাদের ভূমিকা ছিল, তারা সংগঠনে শঙ্কু-অনুগামী নয়। প্রকাশ্যে অবশ্য ওই ‘অরাজকতা’র দায় সিপিএমের উপরেই চাপিয়েছে তৃণমূল শিবির।
তবে শঙ্কুর এ দিনের মন্তব্য রাজ্য সরকারের ‘নীতি’ নয় বলেই জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তিনি বলেন, “শঙ্কু এমন কথা বলেছে কি না, জানি না। খোঁজ নিতে হবে।” ব্রাত্যর মন্তব্যের পর স্বভাবতই তৃণমূলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, শঙ্কু কেন আগ বাড়িয়ে ভাঙড়ে অত ‘আক্রমণাত্মক’ মন্তব্য করতে গেলেন? শিক্ষা ক্ষেত্রে শঙ্কুর ‘সাম্প্রতিক ভূমিকা’ (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অডিটের দাবিতে শিক্ষামন্ত্রীকে ঘেরাও) নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ক্ষুণ্ণ’ বলেই দলীয় সূত্রের খবর। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, সে কারণেই শঙ্কুকে ভাঙড়ে গিয়ে ‘চড়া এবং আক্রমণাত্মক’ সুরে সিপিএম-বিরোধিতা করতে হয়েছে। যাতে সেই সূত্রে দলের অন্দরে শঙ্কুর ‘নম্বর’ কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পায়। |
|
মিছিলের নেতৃত্বে আরাবুল এবং শঙ্কু। ছবি: সামসুল হুদা |
যেমন ভাঙড় কলেজে শিক্ষিকাকে ‘নিগ্রহ’ করেও আপাতত পার পেয়ে যাচ্ছেন দলের প্রাক্তন বিধায়ক তথা ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি আরাবুল ইসলাম। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, তিনি আরাবুলকে ‘সংযত’ আচরণ করতে বলেছেন। পার্থবাবুর কথায়, “ওকে বলেছি মহিলাদের সঙ্গে সংযত আচরণ করতেই হবে। তিনি চোর-ডাকাত হলেও!” কিন্তু পাশাপাশিই দলের শীর্ষনেতৃত্ব জানাচ্ছেন, আরাবুলকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার কোনও প্রশ্ন উঠছে না। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “ব্যাপারটার মধ্যে তো এখন রাজনীতি চলে এসেছে! ওই শিক্ষিকা তো সিপিএমের সংগঠন করেন! ফলে দলের কর্মী হিসেবে আরাবুল ঠিকই করেছে। সিপিএমের হাতে কী করে কলেজটা ছেড়ে দেবে!” ওই নেতার আরও দাবি, ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতাও মনে করছেন, সিপিএমের ‘মহড়া’ নিয়ে আরাবুল ভুল করেননি।
বিরোধী সিপিএম অবশ্য মনে করছে, এ ভাবে তৃণমূলের ‘ঘৃণার রাজনীতি’কে শিক্ষার অঙ্গনেও নিয়ে আসছে প্রধান শাসকদল। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “মা-মাটি-মানুষের সরকার সমাজ-সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এদের অনৈতিক হিংস্র আচরণের প্রতিবাদ করলেই তাঁকে চক্রান্তকারী বা সিপিএম অ্যাখ্যা দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে!”
ওই ঘটনায় তৃণমূল নেতৃত্ব যে দলীয় নেতার ‘পাশে’ই, তার প্রমাণ মিলেছে শঙ্কুর মন্তব্যে। আরাবুলকে পাশে নিয়েই মিছিল করেন শঙ্কু। তার পর পথসভায় জানান, কলেজে পড়াতে গেলে ‘সিপিএম করা চলবে না’। শঙ্কুর কথায়, “৩৪ বছরে রাজ্যের শিক্ষা-ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পুরনো অভ্যাসে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা দেরি করে আসেন। ক্লাস করেন না। আমরা এ সব বরদাস্ত করব না।” ওই ছাত্রনেতার আরও বক্তব্য, “গরিব মেহনতি মানুষের ঘাম-ঝরানো অর্থে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেতন পান। মানুষ ভোট দিয়ে আমাদের ক্ষমতায় এনেছেন। আমাদের দায়িত্ব আছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে ঠিক মতো পরিষেবা আদায় করে নেব। উচ্চশিক্ষা দফতরকে জানিয়েছি, অবিলম্বে এই কলেজে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাজিরার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। কলেজের আর্থিক বিষয়গুলিও খতিয়ে দেখা হোক।”
কলেজের শিক্ষক কমিটির মনোনয়ন নিয়ে ‘মতান্তরের’ জেরে মঙ্গলবার ওই কলেজের এক শিক্ষিকাকে গালিগালাজ করে জলের জগ ছুড়ে মারার অভিযোগ ওঠে আরাবুলের বিরুদ্ধে। তবে আরাবুল দাবি করেন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশের হাজিরায় ‘অনিয়ম’ রয়েছে। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ এবং ‘সংবাদমাধ্যমের কুৎসা’-র প্রতিবাদেই এ দিন মিছিল করে তৃণমূল। মিছিল ঘটকপুকুর হয়ে কলেজের সামনে দিয়ে থানার সামনে সভায় গিয়ে শেষ হয়। সেখানে আরাবুল বলেন, “আমি কোনও সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত নই। তোলাবাজিও করি না। দলের কর্মী-সমর্থকদের পাশে আছি। তাঁদের সুপরামর্শ দিই, সহযোগিতা করি।” তাঁর দাবি, “কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আমায় বলেছিলেন, ঠিকমতো ক্লাস হচ্ছে না। শিক্ষক-শিক্ষিকারা সময়মতো কলেজে আসেন না। আমি তারই প্রতিবাদ জানাতে কলেজে যাই। আমার নামে মিথ্যা রটানো হচ্ছে।” থানায় লিখিত বিবৃতিতেও তিনি জানিয়েছেন, সংবাদমাধ্যম এবং কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ তাঁর বিরুদ্ধে ‘কুৎসা’ রটাচ্ছেন। |
অধ্যাপনার মুকুট পরে কলেজে সিপিএম করবেন,
তা হতে দেব না! ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব!
শঙ্কুদেব পণ্ডা
রাজ্য সভাপতি,
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ |
|
আরাবুল যা-ই বলুন, ওই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকারা কিন্তু এখনও আতঙ্কিত। তাঁদের একাংশের অভিযোগ, তাঁদের উপর ‘নজরদারি’ চালানো হচ্ছে। কলেজের বিভিন্ন দেওয়ালে এ দিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তরফে পোস্টার মারা হয়। তাতে লেখা, ‘সংবাদমাধ্যমে আরাবুলের নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে’, ‘শিক্ষিক-শিক্ষিকারা নির্দিষ্ট সময়ে কলেজে আসছেন না’, ‘শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সিপিএমের হয়ে দালালি করা চলবে না’।
এ দিকে, আরাবুলকে ওই কলেজের পরিচালন সমিতি থেকে বহিষ্কারের দাবি তুলেছে ছাত্র পরিষদ। এ দিন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয় তারা। নিন্দা করেছে আরএসপি-র ছাত্র সংগঠন পিএসইউ-ও। তাদের বক্তব্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্বৈরাচার’ চলছে। |
|
|
|
|
|