অ্যাডলফ হিটলার রচিত ‘মাইন কাম্ফ’ দীর্ঘ ৬৭ বৎসর পর জার্মানিতে প্রকাশিত হইতে চলিয়াছে। কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকিলেও, নাতসিবাদ পুনরায় মাথা চাড়া দিবার ভয়ে জার্মান ভাষায় বইটি এত দিন প্রকাশিত হয় নাই। এ বার তাহা স্কুলপাঠ্য করা হইতেছে, যদিও হিটলারের এই মতাদর্শের পরিণাম কী ভয়ানক হইয়াছিল, সে বিষয়ে রচনাও থাকিবে সেই বইতে। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাইতে হয়। কোনও মত যতই আপত্তিকর বা বিপজ্জনক মনে হউক, তাহার প্রচার বন্ধ করা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। যে কোনও মানুষ তাঁহার মতবাদ নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় বলিবেন, ইহাই কাম্য। সেই মত গ্রহণযোগ্য কি না, সেই বিচার নাগরিকরা করিবেন। যদি নাগরিকের এক অংশের নিকট তাহা আপত্তিকর হয়, তাহা হইলেও গণতন্ত্রের নৈতিকতার স্বার্থে তাহা প্রচারের ব্যবস্থা করিতে হইবে রাষ্ট্রকে। কাহাকে তুষ্ট করিবার জন্য কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কণ্ঠরোধ করা নিতান্ত অন্যায়। যাহার সহিত আমি একমত নহি, তাহার বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করিবার দায় আমার সর্বাধিক ইহাই গণতন্ত্রের মূল বিচার। তাই হিটলারের মতো স্বৈরাচারী মানুষদেরও কথা বলিতে দিতে হবে। বস্তুত ইহাই তাহাদের নৈতিক পরাজয়, কারণ স্বৈরাচারী বিরোধিতা সহ্য করিতে পারে না। ভয় দেখাইয়া, নির্যাতন করিয়া বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করাই তাহাদের শাসনকৌশল। শৃঙ্খলের শক্তির চাইতে স্বাধীনতার শক্তি অধিক, ইহা প্রমাণ করিতেই ‘মাইন কাম্ফ’-কে পাঠ্য করিবার প্রয়োজন ছিল। আশা করা যায়, ইহাতে জার্মানিতে স্বৈরাচারের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ পরাভূত হইবে।
অসহিষ্ণুতার যদি কোনও মাপকাঠি থাকে, তবে সন্দেহ হয়, ভারত তাহাতে উপর দিকে রহিয়াছে। যখনই কোনও বই কিংবা চলচ্চিত্র কোনও ধর্ম, ধর্মগুরু, কিংবা রাজনৈতিক নেতার সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় আঘাত করিয়াছে, তখনই সেই বই কিংবা চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করিবার দাবি উঠিয়াছে। রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক নেতারাও সহজেই সেই মত মানিয়া সেই সকল কণ্ঠ রোধ করিয়াছেন। এ ক্ষেত্রে বইটির বা ছবিটির বক্তব্যের যুক্তি, নান্দনিকতা, গুণগত উৎকর্ষ, কোনও কিছুই বিচার্য হইয়া ওঠে নাই। কিছু প্রভাবশালী মানুষ যে তাহা অপছন্দ করিয়াছেন, তাহাই রাষ্ট্রের নিকট প্রধান বিবেচ্য হইয়া উঠিয়াছে। পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে এই মনোভাব আরও প্রকট হইয়াছে। যে দল যখন ক্ষমতায় আসিয়াছে, তখনই সে তাহার বিরোধী মতবাদগুলি পাঠ্য হইতে সরাইয়া দিবার উদ্যোগ লইয়াছে। এমনকী ইতিহাসের প্রসিদ্ধ তথ্যগুলিও বদলাইয়া দিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। রাষ্ট্র কেবল শান্তিভঙ্গের ভয়ে অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক কাজ করিবে, কিংবা নিজের সুবিধার জন্য স্কুল পাঠ্যকে বদলাইয়া দিবে, ইহার অধিক ভয়ানক সম্ভাবনা আর কিছু নাই। যাঁহারা এমন কাজ সমর্থন করেন, তাঁহারা ভুলিয়া যান যে ব্যাধি অপেক্ষা চিকিৎসা এ ক্ষেত্রে ঢের বেশি ক্ষতিকর হইতে বাধ্য। অর্থাৎ যে মত অথবা দৃশ্য আপত্তিজনক বলিয়া তাঁহারা মনে করিতেছেন তাহা থাকিলে নৈতিকতার যেটুকু ক্ষতি হইবে, সরাইলে ক্ষতি হইবে তাহার অনেক বেশি। কারণ তাহা এই বার্তা সমাজে পৌঁছাইয়া দিবে যে, অন্যের কণ্ঠরোধ করা আপত্তিজনক নহে। ইহা স্বৈরতন্ত্রের বার্তা। |